রবীন্দ্রসঙ্গমে বন্ধুবর্গ : শিলাইদহ পর্ব [ Friends of Rabindranath at Shilaidah ]

১৮৯১ খ্রি থেকে ১৯০১ খ্রি পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ ও তদসংলগ্ন অঞ্চলে কাটিয়েছেন। সেসময়ে কবি তাঁর বন্ধুদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে শিলাইদহ -এ যেতে বলতেন। বন্ধুরা যেতেন, পদ্মার বাচা মাছ খেয়ে কবির বোটে নৌকাবিহার সেরে কবির কন্ঠে গান শুনে চলে যেতেন নিজেদের কর্মস্থলে। এরকম কয়েকজন বন্ধুদের নিয়ে এই আলোচনা।

রবীন্দ্রসঙ্গমে বন্ধুবর্গ : শিলাইদহ পর্ব


এখানে ৬ জন বন্ধু/বন্ধুসম ব্যক্তিদের নিয়ে আলোচনার প্রয়াস করা গেল।




ক। অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় (১৮৬১-১৯৩০)

অক্ষয় মৈত্রেয় ছিলেন রাজশাহীর উকিল পাশাপাশি একজন পুরাতাত্ত্বিকও বটে। তিনি লুপ্ত রেশম রেশম শিল্পকে পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে বিভিন্ন উদযোগ গ্রহন করেছিলেন। একবার তিনি অনেকগুলি রেশম-গুটি কবিকে উপহার দিয়েছিলেন।
সেই রেশমকীট থেকে ধীরে ধীরে লক্ষকীটের জন্ম হলো। তাদের খাদ্য জোগানো এবার সমস্যায় পর্যবসিত হলো। সেই সংকট মুহূর্তে ত্রাতা হিসেবে এগিয়ে এলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথের গৃহশিক্ষক লরেন্স সাহেব। তারপর থেকে লরেন্স সাহেব রেশম কীটের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন।

খ। লোকেন্দ্রনাথ পালিত

রবীন্দ্রনাথের চেয়ে সামান্য কয়েক বছরের ছোটো লোকেন্দ্রনাথ পালিত রবি কবির কিশোর বয়সের বন্ধু। রবীন্দ্রনাথ যখন ইংল্যান্ড থেকে দেশে ফিরে এলেন সেসময় লোকেন্দ্রনাথ ব্যারিস্টারি পড়তে লাগলেন। দেশে ফিরে লোকেন হলেন রাজশাহীর জজ। 
মাঝে মাঝে রবীন্দ্রনাথ বন্ধু লোকেনের সঙ্গ প্রত্যাশায় পদ্মানদী ধরে রাজশাহী যেতেন। সেখানে লোকেনের বাড়িতে সাহিত্যের আয়াওর বসতো। একবার "রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন" এর আমন্ত্রণে প্রবন্ধ পাঠ করলেন, 'শিক্ষার হেরফের' প্রবন্ধ। তাছাড়া সেখানে প্রায়ই কবিকে সকন্ঠে গান শোনাতে হতো।


এই দুই বন্ধুর প্রসঙ্গে প্রমথনাথ বিশী বলেছেন,
লোকেনে পাণ্ডিত্য বেশি, রবীন্দ্রনাথে প্রতিভা ; লোকেনে জ্ঞানের বিস্তার,  রবীন্দ্রনাথ পুষিয়ে নেন গভীরতায়।

যাইহোক শিলাইদহ -এ যখন লোকেন্দ্রনাথ আসতেন তখন তাদের  কাব্যালোচনায় রাত গভীর হয়ে যেত। একবার হয়েছে কী,  অনেক রাত পর্যন্ত আলোচনা করে লোকেন ঘুমিয়ে পড়েছেন -- এদিকে মোমবাতির আগুনে মশারি জ্বলে উঠেছে। হঠাৎ আলোর আভায় সচকিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ ছুটে এসে মশারি টেনে খুলে ফেলে সে যাত্রায় বন্ধুকে রক্ষা করেন।

গ। নাটোরের রাজা জগদিন্দ্রনাথ রায় 
( ১৮৬৮-১৯২৫ )

নাটোরের মহারাজা কখনো আসতেন কবিকে প্রতিদর্শন দিতে। তিনি খুব মিশুকে ছিলেন, বালকদের সঙ্গে অবলীলায় মিশে যেতে পারতেন। তিনি শিলাইদহ -এ এলেই বালকেরা তাঁকে ঘিরে ধরতো। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথকে তিনি প্রায়ই বলতেন,
রথী রে, মহারাজা কখনো যেন হতে চাসনে

ঘ। প্রিয়নাথ সেন ( ১৮৫৪ - ১৯১৬ ) 

ব্যারিস্টার প্রিয়নাথ সেনের  সাহিত্যবোধের উপর রবীন্দ্রনাথের বেশ আস্থা ছিলো। উল্লেখ্য যৌবনের প্রায় সব লেখাই প্রিয়নাথের রসবোধের কষ্ঠিপাথরে যাচাই করে নিতেন রবীন্দ্রনাথ।  যদিও এই নির্ভরশীলতা পরবর্তীতে ছিল না।

যাইহোক যখন প্রিয়নাথ শিলাইদহে  আসতেন  তখন কবিতে আর রসিকে বেশ আসর জমত।

ঙ। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩)

দ্বিজেন্দ্রলাল ছিলেন কুষ্ঠিয়ার হাকিম। মাত্র ৫-৬ মাইল দূরের শিলাইদহে সময় পেলেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। তিনি হাসির গান গেয়ে শ্রোতাদের আমোদিত করতে পারতেন। তাঁর চরম অবদান শিলাইদহে আলুচাষের প্রবর্তন। দ্বিজেন্দ্রলাল হাকিম হলে কি হয়, তিনি কিন্তু বিলেত-ফেরত কৃষিবিদ ছিলেন।

কৃষিবিদ হলেও দ্বিজেন্দ্রলাল কোথাও তাঁর বিদ্যা প্রয়োগের সুযোগ পাননি। এবার শিলাইদহে কবির উৎসাহে দ্বিজেন্দ্রের লুপ্ত ইচ্ছা স্ফুরিত হলো। এককথায় কবিগুরুর উৎসাহে জমি তৈরি হলো, দ্বিজেন্দ্রলাল বীজ আনালেন। তারপর আলু রোপিত হলো। সমস্তরকম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করা সত্ত্বেও যথাকালে যখন ফসল তোলা হলো তখন দেখা গেল -- বীজের তুলনায় ফসল অনেকটাই কম। এহেন ফলাফলে দ্বিজেন্দ্রলাল আর কখনো অধীত কৃষিবিদ্যা প্রয়োগের প্রয়াস করেননি।

তিনি প্রায়ই শিলাইদহ -এ রবীন্দ্রনাথের আসরে উপস্থিত থেকে কাব্যালোচনায় মন দিতেন।

চ। জগদীশচন্দ্র বসু (১৮৫৮-১৯৩৭)

জগদীশচন্দ্র বসু তখন প্রেসিডেন্সি কলেজের শিক্ষক। প্রায়ই সাপ্তাহিক ছুটি কাটাতে তিনি রবীন্দ্রনাথের ডেরায় আসতেন। শনিবার সন্ধ্যায় এসে সোমবার সকালে ফিরে যেতেন। তিনি এলে কবি পেতেন গুনমুগ্ধ শ্রোতা, আর পুত্র রথীন্দ্রনাথ পেতো সহৃদয় শিকারি।

বিজ্ঞানীর সঙ্গে কবির চুক্তি হয়েছিল যে, কবিকে প্রতিবার একটি করে নতুন গল্প শোনাতে হবে। এই চুক্তি দীর্ঘকাল বলবৎ না থাকলেও এই চুক্তি রক্ষিত হয়েছিল।  প্রমথনাথ বিশী এ সময়ের  জগদীশের প্রেরণায় রচিত ৮ টি গল্পের সন্ধান দিয়েছেন। সেগুলি হলো -
সদর ও অন্দর
উদ্ধার
দুর্বুদ্ধি
ফেল
শুভদৃষ্টি
যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ
উলুখড়ের বিপদ
প্রতিবেশিনী


শুধু তাই নয়, এই পর্বে জগদীশের চাহিদায় ও প্রেরনায় লিখিত হয়েছিল অনেকগুলি কবিতা ( কথা ও কাহিনী'র) এবং কয়েকটি নাট্যকাব্য।

গরমের শুরুতে রাতের আহার শেষে কবি ও বিজ্ঞানী নৈশ নৌকাবিহারে বের হতেন। তখন কবি গাইতেন জগদীশের প্রিয় গানগুলি।

ছ। অমলা দাশ

এছাড়াও আসতেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ভগিনী অমলা দাশ। শিলাইদহে এলে তিনি সারাদিন  মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে নানারকম ব্যঞ্জন ও মিষ্টান্ন রান্না করতেন। আর সন্ধ্যায় বোটে গানের আসরে কবি গান থামালে অমলা গাল শুরু করতে।




কৃতজ্ঞতা : প্রমথনাথ বিশী 

মন্তব্যসমূহ