ভাষাবিজ্ঞান : কয়েকটি অজানা প্রসঙ্গ
[১] স্পুনারিজম, Spoonerism
কোনো বাক্যের বা বাক্যাংশের দুটি শব্দের আদ্য ব্যঞ্জনধ্বনি যদি পরস্পর স্থানবিনিময় করে, এবং তার ফলে একটি কৌতুকপূর্ণ নতুন বাক্য বা বাক্যাংশ তৈরি হয়, তাকেই স্পুনারিজম বলে। এটি একধরনের বিপর্যাস, ধ্বনির নয় বাক্য বা বাক্যাংশের।
অক্সফোর্ড-এর নিউ কলেজের ওয়ার্ডেন রেভারেন্ড স্পুনার (W A Spooner) প্রায়শই এই ধরনের বিপর্যাস করে ফেলতেন। তাঁর বলা কয়েকটি কথা উল্লেখ করা হলো---
১. বলেছিলেন --- 'hissed my mystery lectures'. অথচ বলতে চেয়েছিলেন--- 'missed my history lectures'.
২. বলেছিলেন --- 'who has pissed the most'. অথচ বলতে চেয়েছিলেন --- 'who has missed the post'.
বাংলাতেও এর দৃষ্টান্ত রয়েছে---
১. এক চাপ কা [এক কাপ চা]
২. কাক ছড়ালে ভাতের অভাব [ভাত ছড়ালে কাকের অভাব]
আসলে দ্রুত বলতে গিয়েই এই ধরনের বিপর্যাস আমরা প্রায়শই করে ফেলি।
[2] সবল ব্যঞ্জন, fortis
যে ব্যঞ্জন ধ্বনির উচ্চারণের মুখের পেশির ও নিঃশ্বাসের বেশি জোর লাগে তাকেই সবল ব্যঞ্জন বলে। সাধারণভাবে অঘোষ (voiceless) ব্যঞ্জনই সবল ব্যঞ্জন। বাংলায় ক, চ, ট, ত, প সবল ব্যঞ্জন। আর ইংরেজিতে p, t, k, এই তিনটিই সবল ব্যঞ্জন। এগুলি মহাপ্রাণিত উচ্চারন হয়।
[৩] স্বার্থিক প্রত্যয়, pleonastic suffix
কখনো কখনো শব্দের সঙ্গে প্রত্যয় যোগ করা সত্ত্বেও শব্দটির অর্থ বদলায় না। এই ধরনের প্রত্যয়কে স্বার্থিক প্রত্যয় বলে। বন্ধু+অ = বান্ধব একটি দৃষ্টান্ত, যেখানে অ প্রত্যয় যুক্ত হওয়া সত্ত্বেও নতুন শব্দটির অর্থ একই থাকল।
[৪] স্বর-পরিব্যক্তি, voice mutation
Adolescence বা বয়ঃসন্ধির সময় কিশোরদের (কিশোরীদের তেমন নয়) স্বরভঙ্গ হয়। কিছুকাল পরে কণ্ঠস্বরের স্বাভাবিক গুন ফিরে আসে। কণ্ঠস্বরের এই পরবর্তী অবস্থাকেই স্বর-পরিব্যক্তি বলা হয়।
[৫] সক্রিয় উচ্চারক, active articulator
বাক প্রত্যঙ্গের বিভিন্ন অংশ বা অঙ্গ উচ্চারক হিসেবে ভূমিকা পালন করে। এই উচ্চারণগুলি দুই শ্রেণীর --- সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয়। যেসব উচ্চারক সচল সেগুলিই সক্রিয়। যেমন, নিচের ঠোঁট, জিভ, নিচের চোয়াল। অন্য দিকে, উপরের পাটির দাঁত, অগ্রতালু বা কঠিন তালু নড়াচড়া করে না, এগুলি স্থির বা প্রায় স্থির। এগুলিই নিষ্ক্রিয় উচ্চারক (inactive articulator)।
[৬] রিক্ত শব্দ, empty word
যে শব্দের স্বাধীন অর্থ থাকে না, তবে তা ব্যাকরণগত ভূমিকা পালন করে, তাকে রিক্ত শব্দ বলে। অনুসর্গ, প্রত্যয়, বিভক্তি, ইংরেজিতে preposition, articles, conjunction প্রভৃতি রিক্ত শব্দ বা empty word. এগুলিকে function word ও বলা হয়।
[৭] সজীব বিশেষ্য, animate word
যে বিশেষ্যবাচক শব্দ সজীব প্রাণীকে নির্দেশ করে তাই সজীব বিশেষ্য। মানুষ, সিংহ, গরু সবই সজীব বিশেষ্যের উদাহরণ।
[৮] অতিশুদ্ধি, hypercorrection
ব্যাকরণের নিয়ম কঠোরভাবে পালন করতে গেলে অনেকসময় অপ্রয়োজনীয় প্রয়োগের ফাঁদে পড়তে হয়। একেই অতিশুদ্ধি বলা হয়। Don't play the music so loud. এই বাক্যে loud হলো adverd বা ক্রিয়াবিশেষণ। তাতে -ly যোগ করে adverd বানানোর প্রবণতা অতিশুদ্ধির লক্ষণ।
[৯] আর্ষপ্রয়োগ
'আর্ষপ্রয়োগ' কথাটির একটি অর্থ বেদোক্ত, বেদে ব্যবহৃত। তা থেকে প্রসারিত অর্থ ঋষিপ্রোক্ত বা ঋষির দ্বারা উক্ত। ভাষার যে সমস্ত প্রয়োগ ব্যাকরণবিরুদ্ধ কিন্তু যেহেতু ঋষিগণের দ্বারা স্বীকৃত, তাকেই আর্ষপ্রয়োগ বলে। বর্তমানে এই অর্থই প্রচলিত।
কাইমোগ্রাফ মুখবিবরের পেশির নড়াচড়া এবং বাগযন্ত্রের তরঙ্গায়িত গতি রেকর্ড করার যন্ত্রবিশেষ। ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত এই যন্ত্র ব্যবহৃত হত। এতে কাগজের উপর বাগযন্ত্রের গতিবিধি রেকর্ড করা হতো। বর্তমানে এই যন্ত্রের ব্যবহার নেই।
[১১] কেয়ারটেকার ভাষা, motherese, caretaker speech
শিশু যখন প্রথম কথা বলতে শেখে তখন মা সহজ শব্দ ব্যবহার করে, উচ্চারণ সরল করে তার ভাষাশিক্ষাকে সহজ করে তোলেন। একেই কেয়ারটেকার ভাষা বলা হয়। এর বৈশিষ্ট্য হলো--
ক। ছোটো ছোটো বাক্যের ব্যবহার।
খ। জটিলতা পরিহার।
গ। সহজ শব্দের ব্যবহার।
মায়ের ব্যবহৃত এই ভাষা শিশুর পক্ষে সহজবোধ্য এবং শিশুর ভাষাশিক্ষায় বিশেষ সহায়ক।
[১২] খাতক ভাষা, borrowing language
এক ভাষা থেকে অন্য এক ভাষার ঋণশব্দ গ্রহণ ভাষার ইতিহাসে এক অতি-পরিচিত বিষয়। যে ভাষা ঋণ গ্রহণ করে তাকে বলা হয় খাতক ভাষা। বাংলা ভাষায় যখন বিদেশি ঋণ নেওয়া হয়, তখন বাংলাকে খাতক ভাষা বলা হবে। অন্যদিকে ইংরেজি ভাষায় যখন guru, mantra ইত্যাদি ভারতীয় শব্দ গ্রহণ করা হয়, তখন ইংরেজি হবে খাতক ভাষা।
[১৩] ডানমুখী লোপ, right-headed elision
বাক্যে একই ক্রিয়াপদের পুনরাবৃত্তি ঘটলে একটিকে ঊহ্য রাখা শৈলীসম্মত। এই ঊহ্যতা বা লোপ দুরকমের হতে পারে--- ডানমুখী ও বামমুখী।
একই ক্রিয়াপদের পুনরাবৃত্তির ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টির অর্থাৎ পরেরটি বা ডান দিকেরটির লোপকে ডানমুখী লোপ বলা হবে ---
বাবা বাজারে যাবে, দাদা অফিসে (যাবে)।
সে বিড়াল পুষতে চায়, আর ও কুকুর ( পুষতে চায়)।
দুই ক্ষেত্রেই ডানদিকের পুনরাবৃত্ত ক্রিয়াপদটি লুপ্ত বা ঊহ্য থেকেছে। অন্যদিকে যদি প্রথম বা বাঁ দিকের ক্রিয়াপদ লুপ্ত বা ঊহ্য হয়, তা হবে বামমুখী লোপ ---
তোমার ভাই নয়, আমার ভাই খেলতে নামবে।
তাঁর কলম নয়, আমার কলম হারিয়েছে।
[১৪] দ্বিভাষিক, bilingual
যে ব্যক্তি দুটো ভাষাতেই দক্ষতা অর্জন এবং দুটো ভাষাই ব্যবহার করে, সে-ই দ্বিভাষিক। ওয়েলস-এর বহু মানুষ ওয়েলশ ভাষা ও ইংরেজি ভাষায় কথা বলে। ভারতে বহু মানুষ মাতৃভাষা ও ইংরেজি এই দুটো ভাষায় কথা বলে।
একটু ভিন্নভাবেও বলা যায়, যে সমাজে দুটি ভাষা সমানভাবে চালু বা ব্যবহৃত, সেই ভাষিক সমাজ 'দ্বিভাষিক'।
[১৫] নামরোধ, নামস্মৃতি লোপ, anomia
মস্তিষ্কের ত্রুটির কারণে নাম মনে করতে না-পারার নাম 'নামরোধ' বা 'নামস্মৃতি লোপ'। এক্ষেত্রে অন্যান্য বিষয়ের স্মৃতি অটুট থাকলেও, ব্যক্তির নাম বা বস্তুর নামের স্মৃতি লোপ পায়।
[১৬] নিভাষা, idiolect
কোনো ব্যক্তির ভাষা ব্যবহারের নিজস্ব ভঙ্গি বা স্টাইল থাকতেই পারে। উচ্চারণের ভঙ্গি, শব্দ নির্বাচন ইত্যাদিতে কিছু নিজস্বতা থাকতে পারে, স্বরভঙ্গিও আলাদা হয়। এই সব নিয়েই ব্যক্তির নিজস্ব ভাষা, যাকে নিভাষা বা ideolect বলা হয়। এই নিভাষা দিয়েই ব্যক্তির বাচনক্রিয়া থেকে আলাদা করে চেনা যায়।
[১৭] বাক্যনোঙর, complementizer
এই পরিভাষাটি ভাষাবিজ্ঞানী প্রবাল দাশগুপ্তের। বাক্যের দুটি অংশের মধ্যে সংযোজক হিসাবে ভূমিকা পালনকারী অব্যয়ই বাক্যনোঙর। 'আমি জানতে চাই তুমি কাল আসবে কি না'--- এই বাক্যে 'কি না' হলো বাক্যনোঙর। এটি সংবর্তনী-সঞ্জননী ব্যাকরণে প্রথম ব্যবহৃত হয়।
ঋণ : সুভাষ ভট্টাচার্য
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন