'শিকার' জীবনানন্দের উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলির মধ্যে অন্যতম। এই কবিতায় ভোরের শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশে শহুরে হৃদয়হীন মানুষের নিক্ষিপ্ত গুলিতে বনের শোভা একটি হরিণের হত্যা এবং অনতিবিলম্বে তার খাদ্যে পরিণত হওয়ার নারকীয়, পাশবিক ঘটনাকে কবি সংহত আবেগ, সংক্ষিপ্ত ভাষায় বেঁধেছেন। এর মধ্যে দিয়ে আধুনিক মানুষের নৃশংস হৃদয়হীনতার দিকটিকে উদ্ভাসিত করার দিকেই কবির দৃষ্টি নিবদ্ধ। তা করতে গিয়ে কবিতার সমাপ্তিতে কবি তীব্র ব্যঞ্জনাময় স্তবক যোজনা করেছেন ---
কোনও কোনও সমালোচক 'নিরপরাধ' বিশেষণটিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে উৎকেন্দ্রিকতা উদ্বায়ী কল্পনার তুবড়ি ছুটিয়েছেন। তাঁদের মতে 'নিরপরাধ' বলতে কবি নাকি 'হরিণ'কে বুঝিয়েছেন। সে-ই নাকি ঘুমের দেশে যাত্রা করেছে (অথচ ততক্ষনে সে রন্ধিত মাংস হয়ে শিকারিদের রসনা চরিতার্থ করছে !)।
এ ধরনের ব্যাখ্যা আমাদের হতাশ করে। এ প্রসঙ্গে একজন সমালোচকের বক্তব্য উদ্ধার করে দেখানো যায় 'নিরপরাধ' বলতে কবি ঠিক কাকে/কাদেরকে বুঝিয়েছেন---
এখন আর ট্রিগারে আততায়ীর আঙুল নেই, বন্দুকের লোহার কাঠামোতে গরম নেই, বুলেট ছোঁড়ার কাঁপন নেই, যেন কিছুই হয়নি এমন ক্যামোফ্লেজ যেন, কোথাও কোন পাপবোধ বা অনুশোচনা নেই। তবু একটা হরিণ, একটা জীবন, একটুকরো চলমান সৌন্দর্য শুধু বেঘোরে শেষ হয়ে গেল। এমন নির্দয় নির্বোধ নিস্পৃহতাকেই কবি বিশেষিত করেছেন 'নিরপরাধ' শব্দ ব্যবহার করে।
অধ্যাপক হিমবন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
সাম্প্রতিককালে তারকা সলমন খানের নিরপরাধ ফুটপাতবাসীদের গাড়িচাপা দিয়ে নিরীহ মনোভাবের প্রকাশ, গায়ক অভিজিৎ-এর এই সম্পর্কে কুৎসিত মন্তব্য এই বক্তব্যকে কি জোরালো করে না ?? কিংবা নির্ভয় হত্যাকাণ্ডের ধর্ষণকারীদের মনোভাব!!
সত্যিই তো খুনি, ধর্ষণকারীদের বিবেক যদি না জাগে, যদি না তাদের মধ্যে অনুশোচনা, অনুতাপ না জাগে তবে তারা নিরপরাধ নয়তো কি!! অন্তত নিজেদের কাছে।
বক্ষ্যমাণ কবিতায় কবি এমন মনোভাবের মানুষদেরকেই বক্রবাচনে বেঁধেছেন। এখানেই কবিতাটি উত্তরাধুনিক বিবর্ণ যুগের পাশবিক সভ্যতার স্বরূপ জাগানিয়া হয়ে উঠেছে।
----------------------------------------------------------------
সূত্র : সঞ্জীব দাস, পরিচয়, আগস্ট-অক্টোবর, ২০১৫
সংশ্লিষ্ট গ্রন্থ :
হিমবন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, আমার জীবনানন্দ, বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ
আপনাদের মন্তব্য জানান।
উত্তরমুছুন