প্রাকৃত-অপভ্রংশ সাহিত্যের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের সম্পর্ক যে ঘনিষ্ঠ তার প্রমাণ কয়েকটি প্রাকৃত-অপভ্রংশ গ্রন্থ আলােচনা করলে পাওয়া যায়। অবশ্য নিশ্চিত ভাবে বাংলাদেশে রচিত হয়েছে এমন প্রাকৃত অপভ্রংশ গ্রন্থ হয়তো পাওয়া যাবে না। বিশেষতঃ গাথা-সপ্তশতী ও প্রাকৃতপৈঙ্গল বাংলাদেশের সংকলনই নয়। কিন্তু বাঙালি জীবনের অনুরূপ চিত্রে, উত্তরকালীন বাংলা সাহিত্যের বিশেষতঃ বাংলা সাহিত্যে বাহিত কৃষ্ণকথার সাধর্মে সংকলন দুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গাথাসপ্তশতী
মাহারাষ্ট্রী প্রাকৃতে রচিত গাথাসপ্তশতীর শ্লোকগুলিতে সাধারণ মানুষের জীবন চিত্রণের সঙ্গে সঙ্গে দেবদেবীদের লীলাও বর্ণিত হয়েছে। প্রাসঙ্গিক ভাবে কৃষ্ণলীলাবর্ণনামূলক কিছু কিছু শ্লোকও আমরা এই সংকলনে পাচ্ছি। কৃষ্ণকথাপ্রসঙ্গে এই সঙ্কলনটির গুরুত্ব অসাধারণ। কারণ এই সঙ্কলনেই কৃষ্ণকথার বৃত্তে সেই উজ্জ্বলতম সংযােজন—রাধা প্রসঙ্গের অবতারণা ঘটেছে। অবশ্য পঞ্চতন্ত্রেও আমরা বিষ্ণুপ্রিয়া ও গােকুলজাতা রাধা নামটি পেয়েছি।
বাণের 'হর্ষচরিতে' গ্রন্থটিকে সাতবাহনের সঙ্কলিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ইতিহাসে সাতবাহন রাজাদের যে কাল বর্ণিত হয়েছে তা খ্রীষ্টীয় প্রথম-দ্বিতীয় শতাব্দী। অথচ সঙ্কলিত গাথাগুলির ভাষা এত প্রাচীন বলে মনে হয় না। খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতকের মধ্যবর্তী সময়ে এটি সঙ্কলিত হয়েছিল বলে কীথ মনে করেন। কিন্তু ড. সুকুমার সেনের মতে এই সঙ্কলন ৪০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ৮০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে পূর্ণাঙ্গ হয়েছিল। জার্মান পণ্ডিত উইণ্টারনিজ বলেন খ্রীষ্টীয় তৃতীয় শতক থেকে সপ্তম শতকের মধ্যে এটি সঙ্কলিত হয়েছিল। এর কাল সম্পর্কে ড. সেন আরও বলেছেন, এই গ্রন্থের যে সমস্ত পুঁথি পাওয়া গেছে—তার সবগুলিতে সাতশত শ্লোক পাওয়া যায় নি। বাণও একে সপ্তশতী বলে উল্লেখ করেননি। তাই অনুমান করা যেতে পারে, সাতবাহন নরপতি হাল খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যে এর সঙ্কলন কার্য আরম্ভ করলেও পরবর্তীকালে আরও নানা জনের দ্বারা খ্রীষ্টীয় অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত এর সঙ্কলনকার্য চলছিল।
লৌকিক জীবনে প্রচলিত কৃষ্ণকথার যে পশ্চাৎপট আমরা এই গাথাসপ্তশতীর সাহিত্য দর্পণে প্রতিফলিত দেখি--সমকালীন শিল্পকলাতেও তার প্রভাব পড়েছিল। পাহাড়পুরের স্থাপত্য শিল্পই তার নির্দশন। তাছাড়া, গাথাসপ্তশতীর রাধা পাহাড়পুরের সেই বিতর্কিত ২২ নং চিত্রের নারীমুর্তি ব্যাখ্যার (রাধা অথবা সত্যভামা) একটি নতুন সঙ্কেতও নিয়ে আসতে পারে। এই প্রসঙ্গে আমাদের মনে হয় রাধা-কৃষ্ণ আশ্রয়ী যে কৃষ্ণকথা এতদিন লােকজীবন এবং লােককথাকে আশ্রয় করে বহমান ছিল—এই সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতেই তা ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার তাগিদে শিল্পে-সাহিত্যে স্ফুটতর বিকাশমানতা লাভ করেছে।
পূর্বেই বলা হয়েছে, রাধাকৃষ্ণের একত্র উল্লেখও এই গাথাসপ্তশতীরই একটি শ্লোকে পাওয়া গেছে---
মুহমারুএণ তং কণ্হ গােরঅং রাহিআএঁ অবণেন্তো।
এতাণঁ বল্লবীণং অণ্ণাণ বি গােরঅং হরসি৷৷
এই প্রসঙ্গে আমাদের যেটা লক্ষণীয় বিষয় তা হলাে রাধার নামটুকুই শুধু নয়–অন্যান্য গােপিনীদের তুলনায় কৃষ্ণপ্রিয়া রাধার উৎকর্ষও এখানে ঘােষিত হয়েছে। অর্থাৎ কৃষ্ণকথার অনুষঙ্গে রাধার নামটিই আমরা কেবল পাচ্ছি না— প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যধারার কৃষ্ণকথায় রাধার যে আসন তা সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীর সাহিত্যেই সুনির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল। গাথাসপ্তশতীর এই রাধানামাঙ্কিত শ্লোককে অনেকে পরবর্তীকালের সংযােজন বলে মনে করে থাকেন। কিন্তু কৃষ্ণলীলা বিষয়ক এই একটি মাত্র পদ যদি আমরা এখানে পেতাম—তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই এই সংশয় জাগতে পারতাে। তার পরিবর্তে একাধিক পদ এখানে পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং পূর্ণাঙ্গ অবয়ব অঙ্গীকারের পরেও এই প্রক্ষেপ—এমন সংশয় অমূলক।
গাথাসপ্তশতীর অন্যান্য কয়েকটি শ্লোকেও গােপীকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ রয়েছে। একটি শ্লোকে কৃষ্ণকে এখনও বালক ভেবে জননী যশােদার সস্নেহ উক্তি গােপিনীদের কিরূপ মনােভাব উদ্ৰিক্ত করছে—তার একটি চমৎকার চিত্র রয়েছে। এখানে যুগপৎ বাৎসল্য ও মধুর রসের মিশ্রণ ঘটেছে। এই ধরনের বিমিশ্র রসব্যঞ্জক পদের উদাহরণ পরবর্তীকালে বৈষ্ণব পদাবলীতেও পেয়েছি। অপর একটি শ্লোকে দেখি গােপীপ্রেমের চাতুর্যময় গভীরতার উৎসার—
ণচ্চণ-সলাহণ ণিহেণ পাস-পরিসংঠিআ নিউণ গােবী।
সরিস গােবিআণঁ চুম্বই কবােল পডিমা-গঅং কণ্ হ।।
কৃষ্ণকে চারপাশে ঘিরে গােপিনীদের এই নৃত্য রাসনৃত্যের অনুরূপ। অপরা গােপীর গণ্ডে প্রতিবিম্বিত কৃষ্ণমুখ চুম্বন করার মধ্যে গােপিনীদের গভীর প্রেমের পরিচয়ই ফুটে উঠেছে।
গাথাসপ্তশতীর অপর একটি পদে রাধা এবং কৃষ্ণের নাম না থাকলেও গােপীপ্রেমের উল্লেখ রয়েছে। শালিক নামক এক গাথাকারের গাথায় আছে---
মহু-মাস-মারুআহঅ-মহুঅর-ঝংকার-নিবভরে রণ্ণে।
গাঅই-বিরহকখরাঁবদ্ধ-পহিঅ-মণ-মােহণং গােবী ।।
অর্থাৎ বসন্তকালে মলয়পবনে ভ্রমরঝংকারে অরণ্যভূমি পরিপূর্ণ হয়েছে। গােপীরা বিরহের গানে পথিকদের মন মােহিত করছে। ঠিক এই ভাবেরই একটি শ্লোক জয়দেবের গীতগােবিন্দেও আছে।
কৃষ্ণ-গােপীসংক্রান্ত পদ ছাড়াও গাথাসপ্তশতীতে প্রাকৃত নায়িকার প্রেমের যে বিচিত্র স্তর লক্ষ্য করা যায়--- তার মধ্যে পরবর্তীকালীন রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলার আভাস পাওয়া যায়। দীর্ঘ বিরহিণী নায়িকার বিরহযন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ, প্রােষিতভর্তৃকার দীর্ঘকাল প্রবাসী প্রিয়ের অভ্যর্থনা পরিকল্পনা, চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতির পদের কথা মনে করিয়ে দেয়। গাথাসপ্তশতীর কিছু কিছু প্রাকৃত প্রেমের কবিতা পরম্পরাক্রমে ব্যবহৃত হতে হতে বৈষ্ণব সাহিত্যে এসেছে। যেমন অভিসারেরর একটি পদের অনুরূপ প্রাকৃত প্রেমিকার অভিসারপদ কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়েও পাওয়া যাচ্ছে। পরবর্তীকালে গােবিন্দদাসের বিখ্যাত অভিসারের পদেও আমরা অনুরূপ ভাবের পরিচয় পাচ্ছি ।
এই ধরনের আরও বহু দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যেতে পারে। সুতরাং তালিকা আর বেশি না বাড়িয়ে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি, গাথাসপ্তশতীতে প্রত্যক্ষভাবে ব্রজলীলার যে কতিপয় পদ রয়েছে— তা যেমন তাৎপর্যপূর্ণ, তেমনি এতে বর্ণিত প্রাকৃত নরনারীর প্রেমলীলার বিচিত্র পর্যায়ও পরবর্তীকালের কৃষ্ণকথাকে প্রভাবিত করেছে।
প্রাকৃত পৈঙ্গল
গাথাসপ্তশতীর মতােই আমাদের বর্তমান প্রসঙ্গের আর এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান 'প্রাকৃত পৈঙ্গল' নামক শৌরসেনী প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত ছন্দোগ্রন্থ। গাথাসপ্তশতী যেমন উত্তরকালীন কৃষ্ণলীলাকথা নানা বিশিষ্ট উপাদানের উদ্ভবসূত্র আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে— প্রাকৃত পৈঙ্গলও তেমনি বাংলাসাহিত্যের মধ্যযুগীয় কৃষ্ণলীলাকথার কিছু বিশিষ্ট উপাদানের উৎস নির্দেশে সক্ষম। কিন্তু এই প্রসঙ্গের পূর্বেই গ্রন্থটির ইতিবৃত্ত প্রসঙ্গে আসা যাক।
কাশীধামের Prakrit Text Society-র সংস্করণে সম্পাদক ড. ভােলাশঙ্কর ব্যাস সংকলনটিকে চতুর্দশ শতকের বলে অনুমান করেছেন। অন্যান্য পণ্ডিতগণও সংকলনটির কাল সম্পর্কে অনুরূপ অনুমান করেছেন। 'এর সংঙ্কলনস্থান কাশী অর্থাৎ পূর্বভারত বলে এতে বাঙালীর কিছু কিছু রচনা সংকলিত হয়েছে— এমন অনুমান অমূলক নয়। সংকলনকর্তা 'পিঙ্গল ছন্দসূত্রে'র পিঙ্গল কিনা— এ প্রশ্ন উত্থাপিত হলেও তা অগ্রাহ্য হয়েছে। এর বেশি কিছু তথ্য আমরা সংকলনটি সম্পর্কে পাই নি।
কিন্তু মূল গ্রন্থটি অনুসরণ করলে দেখি ইহাতে এমন অনেক শ্লোক আছে, যাহার ভাব, বিষয়বস্তু ও ভাষা কৌশল প্রায়ই বাংলার অনুরূপ। এত সাধারণ জীবনের বিচিত্র রূপায়ণের সঙ্গে সঙ্গে রাধাকৃষ্ণ ও গােপীলীলা প্রসঙ্গও এতে আছে। কিন্তু সব থেকে বড় কথা, মধ্যযুগীয় বাংলা কৃষ্ণকথায় এমন কিছু উপাদান সংযােজিত হয়েছিল যার উৎস নিরূপণে গবেষকগণ বহু চেষ্টা করলেও খুব বেশি প্রাচীন উপাদান হাজির করতে পারেন নি। তেমনি একটি বিষয় হলাে রাধাকৃষ্ণের নৌকালীলা। আর এই নৌকালীলার প্রথম প্রসঙ্গ আমরা পেলাম প্রাকৃত পৈঙ্গলেরই নিম্নোদ্ধৃত এই শ্লোকে—
অরে রে বাহহি কাহ্ন ণাব,
ছােড়ি ডগমগ কুগতিণ দেহি।
তইঁ ইথি ণদিহিঁ সঁতার দেই,
জো চাহহি সাে লেহি৷
--- ওরে ও কৃষ্ণ, নৌকা বাও, টলমল করিয়ে দুর্গতি দিও না। আগে তুমি নদীটা পার করে দিয়ে যা চাও তাই নিও।
আর একদিক থেকেও সংকলনটির যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। গাথাসপ্তশতীর রাধা আমাদের কাছে তার দৈবী সত্তার পরিচয় নিয়ে আসে নি। কিন্তু প্রাকৃত পৈঙ্গলের একটি শ্লোকে রাধাকে অভিজাত পৌরাণিক দেবীদের মধ্যে স্থান দেওয়া হয়েছে। লক্ষ্মী, গৌরী, মহামায়া ইত্যাদি দেবীদের সঙ্গে 'রাঈ' বা শ্রীমতী রাধার নাম একাধিক পুঁথিতে পাওয়া যায়।
লচ্ছী রিদ্বী বুদ্বী লজ্জা বিজ্জা খমা আ দেহীআ। গৌরী রাঈ চুণ্ণা ছাআ কান্তী মহামাঈ।।
কৃষ্ণকথার ক্রমবিকাশে গুরুত্বপূর্ণ আর একটি বৈশিষ্ট্য আমরা এই সংকলনটিতে লক্ষ করি। তা হলাে জয়দেবের কাব্যরীতির অঙ্গীকার। পরবর্তীকালে কৃষ্ণকথায় জয়দেব কিভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন প্রাকৃত পৈঙ্গলের নিম্নোদ্ধৃত পদ থেকে তা সহজেই বােঝা যায়---
জিণি কংস বিণাসিঅ কিত্তি পআসিঅ
মুট্টি অরিট্টি বিণাস করে গিরি হত্থ ধরে,
জমলজ্জুণ ভংজিঅ পঅভর গংজিঅ
কালিঅ কুল সংহার করে জস ভূঅণ ভরে।
চাণুর বিহংডিঅ পিঅকুল মংডিঅ
রাহামুহমহু পাণ করে জিনি ভমর বরে।
সাে তুহ্ম ণরাঅণ বিপ্পপরাঅণ
চিত্তঅ চিংতিঅ দেউ বরা ভব ভীই হর।
যিনি কংস বধ করে কীর্তি প্রকাশ করেছিলেন, মুষ্টিক অরিষ্টকে বিনাশ করেছিলেন, হাতে গিরি ধরেছিলেন, যমলাৰ্জুন ভেঙেছিলেন, পদভরে নির্যাতন করে কালিয়কুল সংহার করেছিলেন, যশে ভুবন ভরে ছিলেন, চাণুরকে দ্বিখণ্ডিত ও আপন কুলকে মণ্ডিত করে ভ্রমরের মতাে রাধার মুখ-মধু পান করেছিলেন, সেই বিপরায়ণ নারায়ণকে চিত্তে চিন্তা কর। তিনি (তােমাকে) ভবভীতিহর বর দান করুন।
কৃষ্ণলীলা বিষয়ে আর যে শ্লোকটি এই সংকলনটিতে পাই তার বিষয়বস্তু কংস-সংহারাদি সাধারণ বিষয়।
কংসসংহারণা পক্ষিসঞ্চারণা।
দেবইডিংভ আ দেউ মে ণিব্ভআ।।
যিনি কংসকে সংহার করেছেন, তিনি গরুড়ের পৃষ্ঠে সঞ্চরণ করেন, এবং যিনি দেবকীপুত্র, তিনি আমাকে অভয় প্রদান করুন।
---------------------------------------------
সাহায্য - সত্যবতী গিরি
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন