১.
রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ জীবন নিয়ে বাঙালি পাঠকের কৌতুহলের শেষ নেই। সকলেই জানেন শান্তিনিকেতন ছেড়েছিলেন রথীন্দ্রনাথ। ছাড়তেই হয়েছিল তাঁকে। প্রচুর নীরব অভিমান, অপমান নিয়ে নিজস্ব এক আশ্চর্য জীবনের সন্ধানে চলে গেলেন সুদূর দেরাদুনে। সেখানে তাঁর পারিবারিক সামাজিক সাংগঠনিক পরিচয় আর রইল না। ব্যক্তি মানুষ রথীন্দ্রনাথকে এই প্রথম যেন দেখা গেল। তুমুল বিতর্কে বিগতস্পৃহ রইলেন। গােটা প্রেক্ষাপট বদলে গেল। কিন্তু তাঁর শিল্পরসিক মনটি রয়ে গেল এক সুরে বাঁধা। দেরাদুনের রাজপুরের মিতালি বাড়ি যাঁরা দেখেছেন তাঁরা লক্ষ করেছেন উদয়নের স্থাপত্যের সঙ্গে এর সাদৃশ্য। সেখানেও কাঠ ও তুলির কাজ তাঁর অব্যাহত ছিল। ছিল বাগান করবার সেই অদম্য নেশা। এক নির্জন দ্বীপে স্বেচ্ছানির্বাসিত হলেন তিনি, সঙ্গে রইল তাঁর শিল্প সৃষ্টির নেশা।
দেরাদুনে যাওয়ার পর প্রথমে রথীন্দ্রনাথ থেকেছেন ভাড়া বাড়িতে। সে বাড়ির ঠিকানা ছিল ২০৯ রাজাপুর রোড। ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৫৩-তে ঐ ঠিকানা থেকে ভাগ্নী নন্দিতাকে চিঠি লিখছেন। তার তিন বছর পরে ১৯৫৬র মাঝামাঝি মিতালি বাড়ি তৈরি হয়। ১৯৫৬ সালের ২২ জুন দেরাদুন সিটি বোর্ডের Executive Officer-কে লেখা চিঠিতে ঠিকানা স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে ১৮৯-এ রাজপুর রােড। (নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, আপনি তুমি রইলে দূরে, দে'জ পাবলিশিং, ২০১২, পৃ. ২০২)
২.
এই বাড়িতেই মারা গিয়েছিলেন রথীন্দ্রনাথ। সারা দেশে তখন রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী উৎসব পালিত হচ্ছে। কেন্দ্র সরকারের যে উদ্যোগ তা রথীন্দ্রনাথের দেই পরিকল্পনা অনুযায়ীই করা। কিন্তু বিশ্বভারতী থেকে রবীন্দ্রজন্মউৎসবের আয়োজনে ডাক পাননি রথীন্দ্রনাথ। সে বছরই তিনি অসুস্থ হন। মৃত্যু হয় একান্তে। তাঁর মৃত্যু ঘিরে যে জটিলতা ও রহস্য সবই হয়েছিল এ বাড়িতেই।
মিতালি বাড়ির সবচেয়ে খুঁটিয়ে বর্ণনা আছে ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের লেখায়-
দেরাদুনে বাড়ি করলেন এক অতিশয় সুন্দর জায়গায়, প্রায় তিনহাজার ফিট উঁচুতে। চারধারে ফুলফলের গাছে ভরা। বাড়ির ঠিক সামনেই একটা উপত্যকা। ঘর থেকেই দু’পাশে পাহাড় আর সামনে একটা বড়ো কিন্তু শুকনো ঝরণা। বাড়িটা...অনেকটা শান্তিনিকেতন উত্তরায়ণের মতন।... অস্ট্রেলিয়া থেকে সাদা জবা এনে আমাকে দিলেন, আর অতি ক্ষুদ্র গােলাপের ঝােপ।... বাড়ির সামনে লতানে আমের বাগান, আর আঙুর।...আমার সবচেয়ে ভালো লাগত তাঁর চামড়া, কাঠ, গন্ধ আর চাটনীর সরঞ্জাম। (ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রথীন্দ্রনাথ জন্ম শতবর্ষ পূর্তি শ্রদ্ধার্ঘ্য, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, ১৯৮৮, পৃ. ৪১-৪২)
আজও শান্তিনিকেতন উত্তরায়ন বাগান রথীন্দ্রনাথের পরীক্ষার সাক্ষ্য দেয়। লতানে আমগাছ আর পেয়ারা গাছ রয়েছে উদয়নের পাশেই।
৩.
গত এপ্রিল মাসে দেরাদুন শহরে গিয়ে খোঁজবার চেষ্টা করেছি এ বাড়িটি। রাজপুর রোড এ শহরের প্রধান রাস্তা। শহরের দক্ষিণে ঘড়িঘর থেকে শুরু হয় উত্তরে মুসৌরির দিকে চলে গেছে এ রাস্তা। দক্ষিণ অংশটি শহরের ঘনবসতি এলাকা। বাজার গড়ে উঠেছে বেহল চক বা অন্য এলাকায়। তারপর উত্তরগামী পথটি ক্রমে কঁকা হয়েছে। পথ ধীরে ধীরে চলে গেছে মুসৌরি পাহাড়ের দিকে। পাহাড়ের নিচে রাজপুর রোডের উত্তরাংশ, অভিজাত পাড়া। রথীন্দ্রনাথের চিঠি অনুযায়ী ১৮৯ এ রাজপুর রোডের ঠিকানা মিলিয়ে মিলিয়ে খুঁজতে গিয়ে কিছুতেই ঠিকানা মেলে না। ১৮৯ অন্য নানা সংখ্যার বাড়ি থাকলে ১৮৯-এ নেই। অবশেষে
সন্ধান দিলেন ১৮৬ রাজপুর রােডের অধিবাসী দ্বারকাদাস দম্পতি।
হাহাকার করতে করতে জয়ন্ত ও রিনি দ্বারকাদাস জানালেন আট মাস আগে বাড়িটি ধূলিসাৎ করা হয়। জয়ব্রত চট্টোপাধ্যায়ের থেকে বাড়িটি কিনেছিলেন হরনাম সিংহ। তারপর ২০০০ সাল নাগাদ বাড়িটি কেনেন জনৈক ভল্লা পরিবার। পাড়া প্রতিবেশীদের বাড়িটিকে রক্ষা করবার মিনতি অগ্রাহ্য করে বাড়িটি ভেঙে ফেলা হয়। বাগানে ছিল বেশ কিছু ভাস্কর্য। সেগুলিও বিনষ্ট হয়। দ্বারকাদাস দম্পতি তাঁদের বাড়ির পিছনে নিয়ে যান। দুটি বাড়ি পাশেই ছিল মিতালি। পিছনে দেখা যেত একইরকম পাহাড়।
ধীর পায়ে ঝােপঝাড়ে ঘেরা একটি ফাঁকা জমির সামনে দাঁড়িয়ে থাকি আমরা। পথের উল্টোদিকে একটি বৌদ্ধ মন্দির। মাথার মধ্যে কাজ করে রথীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকীর সময়ে লেখা ধূর্জটিপ্রসাদের একটি কথা—
দেরাদুনের বাড়ির সাজ-সরঞ্জাম বিশ্বভারতীতে নিয়ে আসাই উচিত। এই মহামূল্য জিনিস নষ্ট হয়ে যাবে দেরাদুনের জলের তোড়ে, আর উইতে। যত শীঘ্র বন্দোবস্ত করা যায় ততই মঙ্গল। (ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রথীন্দ্রনাথ জন্ম শতবর্ষ পূর্তি শ্রদ্ধার্ঘ্য, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, ১৯৮৮, পৃ. ৪৩)
শ্রীলা বসু
রবীন্দ্রভাবনা পত্রিকা
টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট
এপ্রিল-জুন ২০১৯
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন