রবীন্দ্রনাথকে প্রথম অভিনয় করতে দেখি ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে মে মাসে। তাহার পর দীর্ঘ ত্রিশ বৎসর কাল নানা ভূমিকায় তাঁহার অভিনয় দেখিবার সৌভাগ্য হইয়াছিল। বেশীর ভাগই তিনি তাঁহার জীবনের পরিণত বয়সে রচিত নাটকগুলিতে অভিনয় করিতে নামিতেন। কখনও সন্ন্যাসী, কখনও ঠাকুরদাদা, কখনও বা ধনঞ্জয় বৈরাগী বা আচার্য অদীনপুণ্য। পোশাক-পরিচ্ছদ সাধারণত যা পরিতেন, তাহার বেশী অদল-বদল হইত না, রঙ্গমঞ্চে তাঁহাকে কবি রবীন্দ্রনাথই মনে হইত, তাঁহার নিজের কথা নিজের স্বাভাবিক সুরেই বলিয়া যাইতেন। ভাবিতাম রবিকে গোপন করা কোনো ভূমিকার কর্ম নয়, তাঁহার ভাস্বর দীপ্তি ছদ্মবেশের আড়াল মানে না। ভুলিয়া যাইতাম, যে-সকল ভূমিকায় তাঁহাকে অভিনয় করিতে দেখিতাম, সেগুলি তাঁহারই প্রতিরূপ, রঙ্গমঞ্চে দাঁড়াইয়া তিনি নিজের ভূমিকারই প্রায় নিজে অভিনয় করিতেন, তাহাকে অন্য রূপ দেখাইবেই বা কেন?
কিন্তু তিনি যে কত বড় দক্ষ ও কুশলী অভিনেতা তাহা বুঝিবার ও দেখিবার সৌভাগ্য দুই তিনবার ঘটিয়া গেল। ১৩২২ সালে বাঁকুড়া জেলায় ভীষন দুর্ভিক্ষ ঘটে ৷ ইহার সাহাযাকল্পে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে "ফাল্গুনী" অভিনয় করা হয়৷ "ফাল্গুনী" ইতিপূর্বে "ইস্টারে"র ছুটিতে শান্তিনিকেতনে অভিনীত হইয়াছিল, তাহা দেখিয়াও আসিয়াছিলাম। শুনিলাম কবি "বৈরাগ্য সাধন" নামক একটি ক্ষুদ্র নাটিকা লিখিয়া "ফাল্গুনী"তে জুড়িয়া দিয়াছেন, দুইটির অভিনয় একসঙ্গেই হইবে।
"বৈরাগ্য সাধন-এ" রাজসভার দৃশ্যটি হইয়াছিল অপরূপ। যেন কালিদাসের কাব্যের একটি দৃশ্য জীবন্ত হইয়া উঠিল৷ রবীন্দ্রনাথ যখন কবিশেখর সাজিয়া রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করিলেন, তখন সকলে বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া গেলাম। নিতান্ত জানিতাম যে কবি স্বয়ং কবিশেখর সাজিয়াছেন, না হইলে বিশ্বাসই করিতাম না বোধ হয়৷ সে কি আশ্চর্য উজ্জ্বল রূপ, কি অভিনব দীপ্তিময় আবির্ভাব ! কোন মন্ত্রবলে যে তিনি নিজের বয়স হইতে অর্ধেক খসাইয়া ফেলিলেন, তাহা বুঝিতেই পারিলাম না৷ কথা বলিতে যখন আরম্ভ করিলেন, তখন কবিশেখরের ভিতর কবি রবীন্দ্রনাথকে খুঁজিয়া পাইলাম।
১৯২২ খ্রীস্টাব্দে, তখনকার আলফ্রেড থিয়েটারে রবীন্দ্রনাথের "শারদোৎসব" অভিনয় হয়৷ নাটকটির নাম পরিবর্তিত হইয়াছিল আখ্যানবস্তুরও সামান্য কিছু অদল-বদল ঘটিয়া থাকিবে৷ এখানেও কবি রাজকবিশেখররূপে রঙ্গমঞ্চে আসিয়া প্রবেশ করিলেন৷ প্রথমবার এ বেশে তাঁহাকে দেখিয়া দর্শকবৃন্দ যতখানি চমৎকৃত হইয়াছিল, এবারে অবশ্য ততটা আর হইল না!
১৯২৩ খ্রীস্টাব্দে আগস্ট মাসের শেষে পুরাতন এম্পায়ার থিয়েটারে "বিসর্জন" নাটক অভিনীত হয়৷ অনেকদিন ধরিয়া কবির জোড়াসাঁকোর বাডীতে ইহার রিহার্সাল চলিতেছিল৷ কয়েকবার গিয়া তাহা দেখিয়াও আসিয়াছিলাম ৷ প্রথমে স্থির ছিল যে রবীন্দ্রনাথ রঘুপতি সাজিবেন৷ পরে উপযুক্ত 'জয়সিংহ' না পাওয়া যাওয়ার জন্যই বা অন্য কোনো কারণে তিনি রঘুপতির ভূমিকা দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দিয়া স্বয়ং 'জয়সিংহে-র ভূমিকা গ্রহণ করিলেন৷ তাঁহার বয়স ৬২ বৎসর। কিন্তু যুবক-জয়সিংহ সাজিয়া যখন দর্শকদের মুগ্ধ দৃষ্টির সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন, তখন তাঁহার বয়স যে ত্রিশ বৎসরের বেশী তাহা কাহারও মনে হয় নাই৷ কি সতেজ গতিভঙ্গী কি দৃপ্ত ক্ঠন্বর ! কবিশেখর যদিও চক্ষুকে ভুলাইয়া দিতেন, কিন্তু কর্ণকে ভুলাইতে পারিতেন না, মহার্ঘ্য সজ্জায় সজ্জিত যুবক শেখরের কন্ঠে আমরা আমাদের অতি পরিচিত রবীন্দ্রনাথের কথাই শুনিতাম, তাঁহাকে চিনিতে কিছুই বিলম্ব হইত না।
কিন্তু "জয়সিংহে" র মূর্তি শুধু নূতন ছিল না, তাহার কথাবার্তা চালচলন সবই আমাদের কাছে নূতন। ইহার ভিতর কবি ধরা দিলেন না। রবীন্দ্রনাথের দীত্তি ব্যক্তিত্বকে ঢাকিয়া জয়সিংহই সত্য হইয়া দাঁড়াইলেন৷ ইহা যে কতবড় অভিনয়দক্ষতা তাহা কেবল তাহারাই বুঝিবেন, যাঁহারা রবীন্দ্রনাথকে দীর্ঘকাল অত্যন্ত নিকট হইতে দেখিয়াছেন। মধ্যাহ গগনের দীপ্ত ভাস্করকে যেমন আড়াল করা যায় না, তাহার জ্যোতির্ময় সত্তাকেও তেমনি আড়াল করা অসম্ভবই বোধ হইত। দেখিলাম এ ক্ষেত্রেও কবি ঐজজালিক৷
বহু বৎসর পূর্বের কথা, কিন্তু এখনও "বিসর্জনে"র রঙ্গমঞ্চের দৃশ্য চোখের উপর ভাসিতেছে। ...
দুঃখ হয় যে, এই নাট্যাভিনয়গুলি কেন চলচ্চিত্রের সাহায্যে অন্ততঃ কিছুকালের অন্যও স্থায়ী করিয়া রাখা হয় নাই৷ আমরা যাহারা চোখে দেখিয়াছিলাম, কানে শুনিয়াছিলাম, তাহাদের দিন ত শেষ হইতে চলিল, পরবর্তী কালে রিক্ততা খানিকটা হয়ত মোচন হইত, কিন্তু তাহাও দেশবাসীর অদূরদর্শীতার জন্য হইল না ।
সীতা দেবী
গীতবিতান বার্ষিকী ১৩৫০
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন