কাদম্বরী দেবীর উদ্দেশে রবীন্দ্রনাথের গ্রন্থোৎসর্গ





ঠাকুর পরিবারে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর উদ্দেশে রবীন্দ্রনাথ কয়েকটি গ্রন্থ উৎসর্গ করেছেন। রবীন্দ্রজীবনে কাদম্বরী দেবীর ভূমিকা সম্পর্কে কোনো দ্বিমত নেই।  কাদম্বরী দেবীর উদ্দেশে যে গ্রন্থগুলি কবি উৎসর্গ করেছেন তা অধিকাংশই কবির প্রথমদিককার গ্রন্থ। তাঁর মৃত্যু রবি-কবির জীবনে গভীর রেখাপাত করেছিল। এখন আমরা দেখে  নিই গ্রন্থগুলির নাম এবং উৎসর্গিত গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের স্বীকৃতি।


১. ভগ্নহৃদয়


(ক) সাময়িক-পত্রিকায় প্রকাশকালে :

উপহার
রাগিনীছায়ানট

তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা।
এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা।
যেথা আমি যাই নাকো,
তুমি প্রকাশিত থাকো
আকুল এ আঁখি পরে ঢালগো আলোকধারা,
ও মুখানি সদা মনে
জাগিতেছে সংগোপনে
আঁধার হৃদয় মাঝে দেবীর প্রতিমা-পারা।
…. …. ….

[ভারতী, কার্তিক ১২৮৭]


(খ) গ্রন্থাকারে প্রকাশকালে :

উপহার
শ্ৰীমতী হে……………..,
হৃদয়ের বনে বনে সূর্যমুখী শত শত
ওই মুখ পানে চেয়ে ফুটিয়া উঠেছে যত।
বেঁচে থাকে বেঁচে থাক্‌, শুকায় শুকায়ে যাক্‌,
ওই মুখপানে তারা চাহিয়া থাকিতে চায়,
বেলা অবসান হবে, মুদিয়া আসিবে যবে
ওই মুখ চেয়ে যেন নীরবে ঝরিয়া যায় !
স্নেহের অরুণালোক খুলিয়া হৃদয় প্রাণ,
এ পারে দাঁড়ায়ে, দেবি, গাহিনু যে শেষ গান,
তোমারি মনের ছায় সে গান আশ্রয় চায়,
একটি নয়ন জল তাহারে করিও দান।
আজিকে বিদায় তবে, আবার কি দেখা হবে,
পাইয়া স্নেহের আলো হৃদয় গাহিবে গান ?

[গ্রন্থপ্রকাশ : আষাঢ় ১২৮৮]



২. সন্ধ্যাসংগীত


উপহার
[গ্রন্থের সর্বশেষ কবিতা]।





ভুলে গেছি, কবে তুমি
ছেলেবেলা একদিন
মরমের কাছে এসেছিলে,
স্নেহময়, ছায়াময়,
সন্ধ্যাময় আঁখি মেলি
একবার শুধু চেয়েছিলে,
স্তরে স্তরে এ হৃদয় হয়ে গেল অনাবৃত,
হৃদয়ের দিশি দিশি হয়ে গেল উদঘাটিত,
একে একে শত শত ফুটিতে লাগিল তারা,
তারকা-অরণ্য মাঝে নয়ন হইল হারা !
বুঝি গো সন্ধ্যার কাছে 
শিখেছে সন্ধ্যার মায়া
ওই আঁখি দুটি,--
চাহিলে হৃদয় পানে
মরমেতে পড়ে ছায়া,
তারা উঠে ফুটি !
…. …. ….
তোমার নয়ন দিয়া
আমার নিজের হিয়া
পাইনু দেখিতে
কখনো গাওনি তুমি,
কেবল নীরবে রহি
শিখায়েছ গান
স্বপ্নময় শান্তিময়
পূরবী রাগিণী তানে
বাঁধিয়াছ প্রাণ।
…. …. ….

[ প্রথম সংস্করণ, ১২৮৮ ]


৩. যুরোপ-প্রবাসীর পত্র


উপহার

ভাই জ্যোতিদাদা,
ইংলন্‌ডে যাঁহাকে সর্বাপেক্ষা অধিক মনে পড়িত, তাহারই হস্তে এই পুস্তকটি সমর্পণ করিলাম।





গ্রন্থপ্রকাশ ১২৮৮                স্নেহভাজন


                                রবি
                                                                                                                                                         

                                                           

8. বিবিধ প্রসঙ্গ


[গ্রন্থের শেষ রচনা 'সমাপনের শেষ স্তবক]

আমার পাঠকদিগের মধ্যে একজন লোককে বিশেষ করিয়া আমার এই ভাবগুলি উৎসর্গ করিতেছি। এ ভাবগুলির সহিত তোমাকে আরও কিছু দিলাম, সে তুমিই দেখিতে পাইবে ! সেই গঙ্গার ধার মনে পড়ে ? সেই নিস্তব্ধ নিশীথ ? সেই জ্যোৎস্নালোক ? সেই দুই জনে মিলিয়া কল্পনার রাজ্যে বিচরণ ? সেই মৃদু গম্ভীর স্বরে গভীর আলোচনা ? সেই দুই জনে স্তব্ধ হইয়া নীরবে বসিয়া থাকা ? সেই প্রভাতের বাতাস, সেই সন্ধ্যার ছায়া ! একদিন সেই ঘনঘোর বর্ষার মেঘ, শ্রাবণের বর্ষণ, বিদ্যাপতির গান ? তাহারা সব চলিয়া গিয়াছে ! কিন্তু আমার এই ভাবগুলির মধ্যে তাহাদের ইতিহাস লেখা রহিল। এই লেখাগুলোর মধ্যে কিছু দিনের গোটাকতক সুখদুঃখ লুকাইয়া রাখিলাম, এক একদিন খুলিয়া তুমি তাহাদের স্নেহের চক্ষে দেখিও, তুমি ছাড়া আর কেহ তাহাদিগকে দেখিতে পাইবে না। আমার এই লেখার মধ্যে লেখা রহিল, এক লেখা তুমি আমি পড়িব, আর এক লেখা আর সকলে পড়িবে।

[গ্রন্থপ্রকাশ : ভাদ্র ১২৯০]


৫. ছবি ও গান

উৎসর্গ

গত বৎসরকার বসন্তের ফুল লইয়া এ বৎসরকার বসন্তে মালা গাঁথিলাম। যাঁহার নয়ন-কিরণে প্রতিদিন প্রভাতে এই ফুলগুলি একটি একটি করিয়া ফুটিয়া উঠিত, তাঁহারি চরণে ইহাদিগকে উৎসর্গ করিলাম।

[গ্রন্থপ্রকাশ ফালুন ১২৯০]


৬. প্রকৃতির প্রতিশোধ


উৎসর্গ
তোমাকে দিলাম

[গ্রন্থ প্রকাশ : ১২৯১]


৭. শৈশব সংগীত


উপহার

এ কবিতাগুলিও তোমাকে দিলাম। বহুকাল হইল, তোমার কাছে বসিয়াই লিখিতাম, তোমাকেই শুনাইতাম। সেই সমস্ত স্নেহের স্মৃতি ইহাদের মধ্যে বিরাজ করিতেছে। তাই, মনে হইতেছে তুমি যেখানেই থাক না কেন, এ লেখাগুলি তোমার চোখে পড়িবেই।

[গ্রন্থপ্রকাশ : জ্যৈষ্ঠ ১২৯১]






৮. ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী


উৎসর্গ

ভানুসিংহের কবিতাগুলি ছাপাইতে তুমি আমাকে অনেকবার অনুরোধ করিয়াছিলে। তখন সে অনুরোধ পালন করি নাই। আজ ছাপাইয়াছি, আজ তুমি আর দেখিতে পাইলে না।

[গ্রন্থপ্রকাশ : ১২৯১]


৯. মানসী

উপহার

নিভৃত এ চিত্তমাঝে
নিমেষে নিমেষে বাজে
জগতের তরঙ্গ আঘাত
ধ্বনিত হৃদয়ে তাই
মুহূর্ত বিরাম নাই
নিদ্রাহীন সারা দিনরাত
…. …. ….
অন্তরে বাহিরে সেই
ব্যাকুলিত মিলনেই
কবির একান্ত সুখোচ্ছ্বাস
সেই আনন্দ-মুহূর্তগুলি
তব করে দিনু তুলি
সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণের প্রকাশ।

[৩০ বৈশাখ, ১২৯৭]


১০. চৈতালি


উৎসর্গ





আজি মোর দ্রাক্ষাকুঞ্জ বনে,
গুচ্ছ গুচ্ছ ধরিয়াছে ফল।
পরিপূর্ণ বেদনার ভরে
মুহূর্তেই বুঝি ফেটে পড়ে,
বসন্তের দুরন্ত বাতাসে
নুয়ে বুঝি নমিবে ভূতল,
রসভরে অসহ উচ্ছ্বাসে
থরে থরে ফলিয়াছে ফল।
…. …. ….
শুক্তির নখরে বিক্ষত
ছিন্ন করি ফেল বৃন্তগুলি,
সুখাবেশে বসি লতামূলে
সারাবেলা অলস অঙ্গুলে
বৃথা কাজে যেন অন্য মনে
খেলাচ্ছলে লহ তুলি তুলি,
তব ওষ্ঠে দশন-দংশনে
টুটে যাক পূর্ণ ফলগুলি।
…. …. ….

[১৩ চৈত্র, ১৩০২]


১০. (ক)

তুমি যদি বক্ষোমাঝে থাক নিরবধি,
তোমার আনন্দমূর্তি নিত্য হেরে যদি
এ মুগ্ধ নয়ন মোর,-- পরাণ-বল্লভ,
তোমার কোমলকান্ত চরণপল্লব
চিরম্পর্শ রেখে যায় জীবন-তরীতে,--
কোনো ভয় নাহি করি বাঁচিতে মরিতে।
(“কবিতাটি কাব্যন্থাবলীতে চৈতালির সুচনায় কবির হস্তাক্ষরে মুদ্রিত ছিল। চৈতালির পরবর্তী সংস্করণে এটি আর ব্যবহৃত হয় নাই। রচনাবলীতে…. চৈতালির সূচনায় পুনর্মুদ্রিত হইল।’ 

[রবীন্দ্র-রচনাবলী, ৫ম খণ্ড, গ্রন্থ-পরিচয় দ্রষ্টব্য]


১১. কাব্যগ্রন্থ (১৩১০)






আমারে কর তোমার বীণা,
লহ গো লহ তুলে !
উঠিবে বাজি তন্ত্রীরাজি
মোহন অঙ্গুলে !
কোমল তব কমল করে
পরশ কর পরাণ পরে,
উঠিবে হিয়া গুঞ্জরিয়া
তব শ্রবণমূলে !
কখনো সুখে কখনো দুখে
কাঁদিবে চাহি তোমার মুখে,
চরণে পড়ি রবে নীরবে
রহিবে যাবে ভুলে !
কেহ না জানে কি নব তানে
উঠিবে গীত শূন্যপানে
আনন্দের বারতা যাবে
অনন্তের কূলে !





------------------------------------------------------------------

ঋণ : জগদীশ ভট্টাচার্য
---------------------------------------------------

মন্তব্যসমূহ