ব্রজবুলি ভাষা ও সাহিত্যের উদ্ভব কীভাবে হয়েছিল এবং মৈখিল কবি ‘বিদ্যাপতি’র সঙ্গে তার সম্পর্ক কতখানি,তা অনিশ্চিত। তবে এটা ঠিক,পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণ থেকেই পূর্ব ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের কবিদের মধ্যে ব্রজবুলি ভাষায় পদ রচনার দৃষ্টান্ত পাওয়া যাচ্ছে। এই সময়ে আসামের শঙ্করদেব ব্রজবুলি ভাষায় বহু পদ লিখেছিলেন এবং উড়িষ্যার রায় রামানন্দ ব্রজবুলিতে বিখ্যাত ‘পহিলহি রাগ নয়নভঙ্গ ভেল’ রচনা করেছিলেন। এই সময়েই পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার দু’জন কবিকে ব্রজবুলি ভাষায় পদ রচনা করতে দেখি।
[ads id="ads1"]
পশ্চিমবঙ্গের কবির নাম যশরাজ (যশোরাজ) খান। রামগোপাল দাস তাঁর ‘রসকল্পবল্লী’র দ্বাদশ কোরকে লিখেছেন,
যশরাজ খান দামোদর মহাকবি।
কবিরঞ্জন আদি সবে রাজসেবী।
রামগোপাল দাস আরও লিখেছেন যে যশরাজ খান জাতিতে বৈদ্য এবং বৈদ্যখণ্ড অর্থাৎ শ্রীখণ্ড গ্রামের রাঘব সেনের বংশধর।
রামগোপাল দাসের পুত্র পীতাম্বর দাসের লেখা ‘রসমঞ্জরী’তে যশরাজ খানের একটি পদ উদ্ধৃত হয়েছে; পদের প্রারম্ভ ছত্র—
"এক পয়োধর চন্দন-লেপিত আরে সহজই গোর’
এর ভনিতা এই,
শ্রীযুত হুসন/জগতভূষণ
সোই ইহ রস জান।
পঞ্চগৌড়েশ্বর/ভোগপুরন্দর
ভনে যশরাজ খান।
এর থেকে জানা যায় যে, যশরাজ খান যে রাজার ‘সেবী’ ছিলেন, তিনি হোসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রি. )।
এই সময়ে রচিত ত্রিপুয়ায় যে কবির ব্রজবুলিতে লেখা পদ পাওয়া গিয়েছে, তাঁর নাম জানা যায়নি, উপাধি “রাজপণ্ডিত”; তিনি ছিলেন হোসেন শাহের সমসাময়িক ও শত্রু রাজা ত্রিপুরেশ্বর ধন্যমাণিক্যের আশ্রিত। ‘রাজপণ্ডিত’-এর পদের ভনিতাংশ নিচে উদ্বৃত্ত করা হল,
বৈরিহ কে এক/দোশ মরসিঅ
রাজপণ্ডিত ভান।
বারি কমলা/কমল রসিয়া
ধন্যমাণিক জান।।
(বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস থেকে উদ্ধৃত)
পদটি কিন্তু ত্রিপুরায় পাওয়া যায় নি, পাওয়া গিয়েছে নেপালে, মিথিলার কবি বিদ্যাপতির এক পদ সংগ্রহের মধ্যে। সেখানে এ পদ কী করে গেল,তার উত্তর কেউই খুঁজে পান নি। সম্প্রতি ত্রিপুরার ‘রাজমালা’র ধন্যমাণিক্য-খণ্ড-এ এর উত্তর পাওয়া যায়; সেখানে লেখা আছে যে ধন্যমানিক্য ত্রিহত অর্থাৎ মিথিলা থেকে ত্রিপুরায় নাচ-গানের লোক আনিয়েছিলেন,
ত্রিহত দেশ হইতে নৃত্যগীত আনি।
রাজ্যেতে শিখায় গীত-বীর্য নৃপমণি।।
[ads id="ads2"]
ত্রিহতের গায়করা নিশ্চয়ই বিদ্যাপতি প্রভৃতি মৈথিল কবিদের লেখা গান খাইত। সেইসব গানের অনুকরণে ত্রিপুরার রাজপন্ডিত উপরে উল্লিখিত পদটি রচনা করেছিলেন ধরলে অন্যায় হবে না। ত্রিহতের গায়করা তাঁর এই গানটিও কন্ঠস্থ করে এবং দেশে ফিরে সেখানে চালু করে—এইভাবে পদটিও ঐ দেশে যায়।
সুখময় মুখোপাধ্যায়
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন