সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলাম




আমার সুন্দর প্রথম এলেন ছোট গল্প হয়ে, তারপর এলেন কবিতা হয়ে তারপর এলেন গান, সুর, ছন্দ ভাব হয়ে উপন্যাস, নাটক, লেখা (গদ্য) হয়েও মাঝে মাঝে এসেছিলেনধূমকেতু, লাঙল, গণবাণীতে, তারপর এই নবযুগে তাঁর শক্তি-সুন্দর প্রকাশ এসেছিল; আর তা এল রুদ্র-তেজ, বিপ্লবের, বিদ্রোহের বাণী হয়ে[আমার-সুন্দর দৈনিক নবযুগ ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪২]

কবি নজরুল সাংবাদিকতায় গেলেন কেন তার কারণ সন্ধানে দেখা যাবে সমকালীন যুগবৈশিষ্ট্য,সমকালীন রাজনীতি কবিতায় যে বিদ্রোহী সত্তার পরিচয় আমরা পেয়েছি সাংবাদিক জীবনেও তার বাত্যয় ঘটেনি রাজনীতিতে যোগ দেবেন কিনা, মুজাফফর আহমদের এই প্রশ্নের জবাবে নজরুল বলেছিলেন, তাই যদি না দেব তবে ফৌজে গিয়েছিলাম কিসের জন্যে ? কাজী নজরুল বুঝেছিলেন, রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণের জন্যে সংবাদপত্র প্রবল হাতিয়ার হতে পারে আজ আমরা সকলেই জানি মিডিয়ার অপ্রতিহত ক্ষমতা সম্বন্ধে সেই সুযোগও এসে গেল সত্ত্বর


ছবি-- উইকিপিডিয়া


. নবযুগ


সান্ধ্য দৈনিক ২০’’ * ২৬’’ সাইজ এক শিট দাম পয়সা
প্রকাশ স্থান : টার্নার স্ট্রিট রোড কলকাতা
প্রথম প্রকাশ ১২ জুলাই ১৯২০

প্রথম দিন থেকেই এই কাগজ জনপ্রিয় হলো, সঙ্গে সঙ্গে রাজরোষেরও কারণ হয়ে দাঁড়াল ব্যাপারে মুজাফফর আহমেদ লিখেছেন,
নবযুগের গরম লেখার জন্য দুবার তিনবার সরকার আমাদের সতর্ক করেছিল

সবাইকে অবাক করে দিয়ে নজরুল দেখালেন এডিটিং-এর কাজেও তিনি সমান নিপুণ বড়ো খবরকে ছোটো করতে তিনি খুব ভালো পারতেন চির চঞ্চল কবি সম্পাদনার সময় গভীর মনোযোগ দিতেন তাঁর লেখা সম্পাদকীয় সাহিত্যগুণে সমৃদ্ধ থাকত, সঙ্গে তাঁর সহজাত নজরুলি সেন্স অফ হিউমারপরবর্তীকালে তাঁর সম্পাদকীয় নিবন্ধ পুস্তকাকারে গণবাণী নামে প্রকাশিত হয়েছে

নবযুগ যেহেতু সান্ধ্য কাগজ ছিল, তাই এখানে ভোরের কাগজের নির্বাচিত সংবাদ পুনঃপরিবেশনের সুবিধা ছিল। এই নির্বাচিত সংবাদ্গুলো সম্পাদকের সম্পাদনার মাহাত্ম্যে নবযুগের নিজস্ব সংবাদ হয়ে উঠত।

---------------------------------------------
আরো পড়ুন - নজরুলের গ্রন্থপঞ্জি উৎসর্গসহ
--------------------------------------------- 

২. ধূমকেতু


মুদ্রাকর ও প্রকাশক : আফজালুল হক
সাপ্তাহিক, পরে সপ্তাহে ২ দিন
ঠিকানা : ৩২ কলেজ স্ট্রিট, কলকাতা
পৃষ্ঠা : ৮। ক্রাউন ফলিও সাইজ
দাম : ১ আনা।গ্রাহক চাঁদা ৫ টাকা।


ছবি- উইকিপিডিয়া


নজরুলের পরবর্তী কাগজ ধূমকেতু, যাকে নিয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড হয়েছিল।এই পত্রিকা বের হওয়ার আগে নজরুল দৈনিক সেবক [মালিক মৌলানা আকরাম খাঁ] পত্রিকায় ১০০ টাকা মাইনেয় কাজ করতেন। এই কাগজে তাঁর উল্লেখযোগ্য একটি সম্পাদকীয় হলো সত্যেন্দ্রপ্রয়াণগীতি। কিন্তু নিজের মতো কাজ পরের কাগজে করা যায় না। এই পরিস্থিতিতে জনৈক মসউদ আহমদ এর বাংলা কাগজে সম্পাদকের দায়িত্ব নিলেন।

ধূমকেতু পত্রিকাকে সহমর্মিতা জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে শরৎচন্দ্র এবং আরো অনেকেই চিঠি লিখেছিলেন। পত্রিকার মাথা ছাপা হয়েছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের বাণী--

আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু
দুর্দিনের এই দুর্গ শিরে 
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।

--------------------------------------------
আরো পড়ুন-- রবীন্দ্রনাথ ও রোদেনস্টাইন
--------------------------------------------

প্রতিবেদনে, সংবাদ  পরিবেশনে, সম্পাদকীয় নিবন্ধে ধূমকেতু হয়ে উঠল নজরুল প্রতিভার এক রণক্ষেত্র। কবিতায় গদ্যে কঠোর প্রতিবাদ ফুটে উঠত। ব্রিটিশ সরকারকে প্রতিপক্ষ করে প্রথম থেকেই নজরুল কবিতা-গদ্যের তির নিক্ষেপ করছিলেন। সেইসময় এই আতঙ্কে বাড়ির মালিক ধূমকেতুর অফিস বদলাতে বললেন।

ধূমকেতু উঠে এল নতুন ঠিকানায়৭ নং প্রতাপ চাটুজ্জে লেনে। তারপর একদিন ঘটে গেল সেই ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৯২২ সালের ২৬ অক্টোবর পুলিশের গ্রেফতারি পরোয়ানা এল ধূমকেতুতে প্রকাশিত ২টি রচনার অপরাধে
ক) আনন্দময়ীর আগমনে নামক কবিতা
খ) বিদ্রোহীর কৈফিয়ত নামক নিবন্ধ।

আনন্দময়ীর আগমনে কবিতার কিছু অংশ


'আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল? 
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল। 
দেব–শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি,
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?' [সম্পূর্ণ কবিতা দেখুন]

এই কবিতা সংক্রান্ত একটি উল্লেখযোগ্য তথ্যশ্রী মৃণাল কান্তি ঘোষ কবি নজরুলকে তাঁদের আনন্দবাজার পূজা সংখ্যার জন্য একটি কবিতা লিখে দিতে বললেন। এই কবিতাটি সেই জন্যে লিখিত হয়েছিল। খুব সম্ভব আনন্দবাজার (তখনো নতুন) সেই কবিতা ছাপতে রাজি হননি, তাই প্রকাশিত হয়েছিল ধূমকেতুতে।

অফিস তল্লাশি করে পত্রিকাটির সব সংখ্যা বাজেয়াপ্ত হলো। নজরুল গ্রেফতার হলেন এবং ১ বছরের জন্যে সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলেন। সারাবাংলা তোলপাড় হলো নজরুলের কারাবাসে। যাইহোক পুরো মেয়াদ জেল খেটে জেল থেকে ছাড়া পেলেন ১৯২৩-এর ১৫ ডিসেম্বর।

৩. লাঙল


জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সম্পাদনায় নেমে পড়লেন, এবার লাঙল পত্রিকা। ১ম সংখা প্রকাশিত হয় ১৯২৫-এর নভেম্বরে।

লাঙল (লেবার স্বরাজ পার্টির মুখপত্র)
সাপ্তাহিক
সম্পাদক : মণিভূষণ মুখোপাধ্যায় (নজরুলের পল্টন বন্ধু)
প্রধান পরিচালক : কাজী নজরুল ইসলাম

পূর্বের ধূমকেতু পত্রিকার মতো এই পত্রিকাতেও তোলপাড় করা প্রকাশ হতো। নজরুলের সাম্যবাদী কবিতাগুচ্ছ এই পত্রিকা পাতায় প্রকাশিত হয়। যদিও রাজরোষের তীব্রতা খানিকটা স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল তখন। ধূমকেতুর মতো এই পত্রিকা দীর্ঘায়ু ছিল না। কুলিমজুর, কৃষকের গান প্রভৃতি কবিতা থেকেই বোঝা যায় কবির অভিমুখ বদলে গিয়ে সর্বহারা শ্রেণির উপর বর্ষিত হয়।





৪. গণবাণী


১৯২৬-এর আগস্টে লাঙল বদলে হলো গণবাণী। কাগজের দায়িত্ব নিলেন মুজাফফর আহমেদ। গণবাণীতে লেখা হলোবঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিকদল গণবাণীর প্রকাশ ভার গ্রহণ করেছেন। এই দলের পূর্বে প্রকাশিত লাঙল গণবাণীতে পরিবর্তিত হয়ে গেল
লাঙলের তুলনায় গণবাণী অধিক মাত্রায় রাজনৈতিক ছিল। ১৯২৬-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ক্ষুব্ধ নজরুলের দুটি জ্বালাময়ী নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল এই পত্রিকার পাতায়

ক. মন্দির মসজিদ, ৯ ভাদ্র ১৩৩৩
খ. হিন্দু মুসলমান, ১৬ ভাদ্র ১৩৩৩।

নজরুলের সাহিত্য সংগ্রামের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হলো সংবাদপত্র সম্পাদনা। তাঁর নিজস্ব প্রতিভায় পূর্বজ্ঞান ছাড়াই চার-চারটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন।
    
    



সাহায্য— [স্মৃতিকথামুজাফফর আহমদ, পরিকথা পত্রিকা ২০০৮]

মন্তব্যসমূহ