বহুবিবাহ সমস্যা সবদেশেই লক্ষণীয়। আবার সাহিত্য সমাজের কথা প্রকাশ করে। একারণে এই বহুবিবাহ সমস্যা গল্পে-উপন্যাসের বিষয় হয়। বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বাংলা ছোটোগল্পেও বহুবিবাহ সমস্যার কথা উঠে এসেছে।
বাংলা ছোটগল্পে বহুবিবাহ সমস্যা
বাংলা ছোটগল্প রচয়িতারা গল্পের
বিষয় নির্বাচনে বসে সুগভীর সমাজচেতনা ও জীবন অভিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন। এই সূত্রে
সামাজিক নানবিধ সমস্যা তাদের গল্পের বিষয়বস্তু রূপে গৃহীত হয়েছে। বহুবিবাহ এমনি একটি
সামাজিক বিষয় যা বাংলা ছোটগল্প রচয়িতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে রেখেছে। বিভিন্ন লেখকের
বহু বিবাহ-কেন্দ্রিক বেশ কিছু ছোটগল্প পর্যালোচনার পর আমরা দেখতে পাই যে বহুবিবাহ দ্বিবিধ
মাত্রায় বাংলা ছোট গল্পের বিষয় রূপে গৃহীত হয়েছে—
[ads id="ads1"]
(১) বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এক
পুরুষের একাধিক স্ত্রী গ্রহণের রীতি সমাজের বৈশিষ্ট্য। এই ধরনের বহু বিবাহের ঘটনা বাংলা
ছোটগল্পে বেশি করে এসেছে। পুত্রযজ্ঞ, মধ্যবর্তিণী (রবীন্দ্রনাথ), অভাগীর স্বর্গ (শরৎচন্দ্র),
পয়োমুখম্ (জগদীশ গুপ্ত) ইত্যাদি গল্পের কথা এখানে উল্লেখ করতে হয়।
(২) এক নারী কর্তৃক বহু স্বামী
গ্রহণের মতো ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়। প্রফুল্ল রায়ের ‘সাতঘরিয়া’ গল্পের কথা এখানে বিশেষ
ভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে বাংলা ছোটগল্পে এধরনের গল্পের সংখ্যা তুলনায় নগণ্য।
ভিন্ন ভিন্ন লেখকের বহুবিবাহ-কেন্দ্রিক
ছোটগল্পগুলি পাঠের পর এমন সিদ্ধান্ত করা যায় যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বহুবিবাহ নামক
প্রথাটি নারীর প্রতি অত্যাচার অবিচারের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। কোথাও পণ আদায়ের
লোলুপতা, কোথাও পুরুষের ভোগবৃত্তির বহুগামিতা আবার কোথাও নারীর সন্তানহীনতা পুরুষের
বহু বিবাহের কারণ হয়েছে। দু একটি বিরল ব্যতিক্রম ক্ষেত্রে নারীর স্বেচ্ছা অনুমতি নিয়ে
পুরুষকে বহুবিবাহ করতে দেখা যায়।
বহু বিবাহের কারণ যাইহোক না
কেন আমাদের সমাজে এ-প্রথা একটি সামাজিক সমস্যা রূপে বিবেচিত হয়। সেই সমস্যার বাস্তবসম্মত
রূপায়ণে ছোটগল্পকারগণ মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। এ বারে কয়েকটি প্রতিনিধিস্থানীয়
গল্পের আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যার স্বরূপটিকে স্পষ্ট করা হল –
(১) পুত্রযজ্ঞ -- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
উত্তরাধিকারের মোহে কখনো-কখনো
পুরুষের যুক্তির দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে বহুবিবাহের ক্ষেত্রকে প্রশস্ত করে। রবীন্দ্রনাথের
‘পুত্রযজ’ গল্পটি তার একটি প্রামাণ্য উদাহরণ। বিজ্ঞ বৈদ্যনাথ নিজের অজান্তে অন্তঃসত্ত্বা
প্রথম পক্ষের স্ত্রী বিনোদিনীকে কলঙ্কিনী অপবাদে গৃহ থেকে বিতাড়িত করে। মুখ্য কারণ
ছিল পুত্র জন্ম দিতে না পারা। এরপর দশ বছরের মধ্যে তিনি দুবার বিবাহ করেন কিন্তু পুত্র
জন্মানোর পরিবর্তে কলহ দেখা দিল। এই কলহের মধ্যে থেকেও তিনি তৃতীয়বার আবার বিবাহে
উদ্যোগী হলেন কারণ লেখকের ভাষায় : “সংসারে আশারও অন্ত নাই, কন্যাদায়গ্রস্তের কন্যারও
শেষ নাই”।
এই প্রতিচ্ছবি আসলে বহু বিবাহের
এক বাস্তব চিত্র। গল্পশেষে বৈদ্যনাথের অর্থ অপব্যয় ও শ্রেণিবৈষম্যের নমুনা প্রকট হলে
যখন ক্ষুধার্ত শিশু ও তার মাকে দুর করে দিলেন, যে আসলে তার নিজেরই সন্তান। লেখক বৈদ্যনাথের
মতন পুরুষের বহুবিবাহকে স্বার্থপরতা ও ভোগ্যবৃত্তির মোড়কে উত্তরাধিকার পাবার বাসনায়
দেখিয়েছেন। এই বিষময় পরিণতি বহুবিবাহের অন্যতম কারণ।
(২) অভগীর স্বর্গ -- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
পুরুষের বহুবিবাহের ফলে নারীর
জীবনে ও তাদের যৌথ সংসারে যে বিপর্যয়ের অবস্থা নেমে আসে তার অনন্যসাধারণ উদাহরণ দরদী
গল্পকার শরৎচন্দ্রের ‘অভাগীর স্বর্গ' নামক গল্পটি। অন্ত্যজ সমাজের মানুষ রসিক বাগ নিজ
স্বার্থ ও ভোগবৃত্তির কারণে স্ত্রী অভাগীকে ফেলে দ্বিতীয় দার পরিগ্রহ করে সংসার ছেড়ে
চলে যায়। এর ফলে শিশুপুত্র কাঙালিকে নিয়ে চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে যায় অভাগী।
যদিও অভাগী নিজে সতীত্বের সংস্কারে আবদ্ধ থেকে সেই দুঃখ ভুলতে চেয়েছিল। হা-অন্নে অর্থ-সম্পদহীন
জীবনে এই সুযোগে তার উপর নেমে আসে সামাজিক অত্যাচারও। স্বামী পরিত্যক্তা নারী-পুত্রকে
মানুষ করার যে লড়াই চালিয়েছিল তা তার মৃত্যুর মাধ্যমে শেষ হয়ে যায়। বহুবিবাহের
বিষময় ফলেই একটি জীবনের এমন পরিণতি।
(৩) পয়োমুখম্ -- জগদীশ গুপ্ত
মানুষের অর্থ লালসার নিষ্ঠুরতম
প্রাপ্তিযোগের কারণেও যে বহু বিবাহের মতো কদর্য ঘটনা এ সমাজে ঘটে তার প্রমাণ জগদীশ
গুপ্তের ‘পয়োমুখম্’ নামক গল্পটি। বারবার পুত্রকে বিয়ে দিয়ে পণবাবদ নগদ অর্থ উপার্যনের
সুলভ উপায়টি গ্রহণ করেছে এ-গল্পের হৃদয়হীন নিষ্ঠুর শ্বশুর। নিজে কবিরাজ হওয়ার সুবাদে
এ-গল্পের শয়তান শ্বশুরটি বিষপ্র্যোগে নববধূদের খুন করতো। গল্পকার জগদীশ গুপ্ত নির্মম
তিক্ততার সঙ্গে বহুবিবাহের নিষ্ঠুরতম দিকটি এ-গল্পে তুলে ধরেছেন।
[ads id="ads2"]
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন