চর্যাপদের কবি ২৪ নাকি ২৩?

প্রথমেই বলে নিই 'চর্যাপদ' বলতে এখানে শুধুমাত্র হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত ঐ পুথিটিকেই নির্দেশ করা হচ্ছে, যেটি ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। 'পুথি' বলতে এই আবিষ্কৃত পুথিকেই বুঝতে হবে। এখানে বুঝে নেওয়া জরুরি এই কারণে যে, এই আবিষ্কৃত পুথিই আমাদের আলোচ্য।


[ads id="ads1"]


চর্যাপদের কবিসংখ্যা কত?--এই নিয়ে বিস্তর বইয়ে বিভিন্ন কথা বলা হয়েছে। সদর্থে যদি বলতেই হয় চর্যাপদের কবি সংখ্যা, তাহলে বলবো ৮৪ জন। কেননা তিব্বতী মত অনুযায়ী  'চৌরাশী সিদ্ধা' ৮৪ জন সিদ্ধ কবিকেই নির্দেশ করে যারা চর্যাগান রচনা করেছেন। কিন্তু তা আমরা এড়িয়ে গিয়ে বলি যে, না কবির সংখ্যা ২৪ কিংবা ২৩। এখন প্রশ্ন, আমরা কিসের ভিত্তিতে এটি বলি? না সেই হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত চর্যাপদের পুথিই আমাদের ভিত্তি। অর্থাৎ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথিটিই আমাদের কাছে আকর--এটা মেনে নেয়েই এই কবি সংখ্যা নির্দেশ করা উচিৎ।

চর্যাপদের (হরপ্রসাদ আবিষ্কৃত) কবি কতজন? দুটি মত--২৩ এবং ২৪। প্রসঙ্গত বলি, ২৪ জন কবির গান এই পুথিতে নেই। তাহলে কবি সংখ্যা যারা বলছেন ২৪, তাদের যুক্তি কী? আসলে পুথিটির ১০ নং চর্যার টীকার পরে একটি কথা আছে-- “লাড়ীডোম্বীপাদানাং সুনেত্যাদি চৰ্যায়া ব্যাখ্যা নাস্তি"। অর্থাৎ লাড়ীডোম্বীপাদের চর্যার ব্যাখ্যা নেই। এই সেই অতিরিক্ত কবি, যার কোন গান পুথিতে নেই। এখন যদি এই কবিকে গণনায় নেওয়া হয়, তাহলে পুথির গানের সংখ্যা আর ৫০ থাকবে না হয়ে যাবে ৫১। কারণ এই কবির চর্যাগান ছাড়াই ৫০টি  গান ইতঃমধ্যে আছে। 

কিন্তু সত্যিই কি এই পুথিতে ৫১টি গান ছিল? আমাদের বক্তব্য, পুথিতে ৫০টি গানই ছিল। পুথির অভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, এই পুথিটি আসলে একটি 'নোটবই' বা 'মানে বই'। এই পুথি সংকলনের বহু আগে গানের পুথি আর টীকার পুথি আলাদা আলাদা ছিল। পরে বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্রে শিক্ষার্থীদের সুবিধার জন্য গান আর টীকা একটি বইতে সংযুক্ত হলো। যে গানের টীকা আছে সেই গানগুলি এইসব পুথিতে নেওয়া হলো। আর তাই মুনিদত্তের ৫০টি গানের টীকা এবং টীকাকৃত গান পুথিতে গৃহীত হয়েছিল। আমাদের মনে হয়, এই পুথির রচয়িতা গান আর টীকা একসঙ্গে করবার সময় দেখেন যে, 'লাড়ীডোম্বীপাদ'-এর 'সূন' শব্দ দিয়ে শুরু গানের কোনো টীকা নেই। আর তাই পুথির লেখক বা লিপিকর এই লাইনটি নিজে জুড়ে দিয়েছিলেন। কারণ স্বয়ং টীকাকার তো এই ধরণের 'ব্যাখ্যা নেই' মন্তব্য করবেন না।

অর্থাৎ এর থেকে যে বিষয়টি উঠে আসছে তা হোলো, 'শুধুমাত্র গানের পুথি'র প্রথম ৫১টি গানের মধ্যে ৫০টি গানের (লাড়ীডোম্বীপাদের ওই গানটি বাদ দিয়ে) টীকা লিখেছিলেন মুনিদত্ত। কিন্তু এই পুথির লেখক অজ্ঞানতাবশত এই বিষয়টি ধরতে না পেরে ঐ ধরণের মন্তব্য করেছেন। আমাদের সিদ্ধান্ত চর্যাপদের আবিষ্কৃত পুথির কবি সংখ্যা ২৩ এবং গানের সংখ্যা ৫০।


বিষয়টি বিস্তারিত জানতে নির্মল দাশের (চর্যাগীতি পরিক্রমা) লেখাটি পড়ুন: 
 

পুথির দশম গানের টীকার শেষে মন্তব্য আছে “লাড়ীডোম্বীপাদানাং সুনেত্যাদি চৰ্যায়া ব্যাখ্যা নাস্তি"। এই মন্তব্য থেকে বোঝা যায় দশম চর্যার মূল পাঠ ও টীকার পরে এবং একাদশ চর্যার আগে লাড়ীডোম্বীপাদের একটি চর্যা ছিল এবং সেটির সূচনা 'সূন' শব্দ দিয়ে। কিন্তু টীকার অভাবে গানটি লিপিকর বর্জন করেছেন। এই সব তথ্য থেকে মনে হয় শাস্ত্রীর পুথিটি আসলে গান ও টীকার একটি যুক্ত সংকলনের পুথি (collated text)। লিপিকরের সামনে সম্ভবত দুটি আদর্শ পুথি (exemplar text) ছিল একটি শুধু গানের পুথি, তাতে টীকা ছিল না; অন্যটি শুধু টীকার পুথি, তাতে গান ছিল না। এই শুধু গানের পুথিটি একশত গান-সম্বলিত চর্যাগীতিকোষের পুথিও হতে পারে, যা বুধগণ সংকলন করেছিলেন বলে 'চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'র তিব্বতী অনুবাদে উল্লিখিত আছে। তবে গানের যে-পুথি লিপিকর ব্যবহার করেছিলেন, মুনিদত্ত সেই পুথি ব্যবহার করেন নি। তিনি ভিন্ন কোনো পুঁথি ব্যবহার করেছিলেন বলে তাঁর টীকার পাঠের সঙ্গে পুথির মূল গানের পাঠে অনেক জায়গায় ভিন্নতা দেখা যায়।

মুনিদত্ত একশোটি গানের মধ্যে পঞ্চাশটি গান বেছে নিয়ে টীকা লিখেছিলেন, তাই কোনো কোনো চর্যার টীকা তাঁর টীকার বইতে বাদ পড়েছিল। ১০ নং ও ১১ নং চর্যার মধ্যবর্তী লাড়ীডোম্বীপাদের চর্যাটি সম্ভবত এই রকম একটি বাদ-পড়া চর্যা যা মুনিদত্ত টাকার জন্য বাছাই করেননি। সুকুমার সেন অনুমান করেছেন মুনিদত্তের মূলপুথিতে শুধু টীকাই ছিল, গান ছিল না,

"তাই একটি চর্যার টীকার পরেই অপর চর্যার টীকা আরম্ভ করিতে গিয়া টীকাকার প্রায়ই লিখিয়াছেন ‘তমেবার্থ প্রতিপাদয়তি' ইত্যাদি বলিয়া মধ্যে মূল চর্যার ব্যবধান থাকিলে এমন লিখিতেন না”, (চর্যাগীতি পদাবলী, ভূমিকা, ১৮ মে ১৯৬৬, পৃ. ২-৩)।"

 শাস্ত্রী-আবিষ্কৃত পুথির লিপিকর বা পুথির মুল প্রণেতা গানের আদর্শ পুথি থেকে গানগুলি এবং টীকার আদর্শ পুথি থেকে টীকাগুলি সংকলন করেছেন এবং সংকলনের সময় টীকার আগে সংশ্লিষ্ট গানগুলি বসিয়ে দিয়েছেন, তবে এই বসিয়ে দেবার কাজটি ঘটেছে কিছুটা যান্ত্রিকভাবে, তাই তিনি মিলিয়ে দেখেননি গানের পাঠের সঙ্গে টীকাকৃত পাঠের সর্বাঙ্গীণ মিল আছে কিনা। সম্ভবত গোড়ার দিকে গানের পুথি ও টীকার পুথি আলাদা আলাদ প্রচলিত ছিল। পরে শিক্ষাকেন্দ্রগুলিতে ব্যবহারের সুবিধার জন্য একটি পুথির আধারে গান ও তাদের টীকার মুক্ত সংকলনের রীতি চালু হয়। শাস্ত্রীর পুথি এই ধরনেরই একটি সহজ-ব্যবহার্য যুক্ত সংকলনের পুথির প্রতিলিপি।

অনুমান যায় এই ধরনের যুক্ত সংকলনের পুঁথি বৌদ্ধ পণ্ডিত ও বিদ্যার্থীদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় ছিল, তাই এই ধরনের পুথির অনেক প্রতিলিপি তৈরি করা হয় এবং অন্য ভাষাতেও এগুলির অনুবাদ হয়। Grags-pargyal-mchan নামে তিব্বতী অনুবাদক কাশ্মীরি পণ্ডিত কীর্তিচন্দ্রের তত্ত্বাবধানে সম্ভবত চতুর্দশ শতকের প্রথমার্ধে নেপালের স্বয়ম্ভু বিহারে এই ধরনের পুথির তিব্বতী অনুবাদ করেন এবং ১৭৪১-৪৯ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে চীনে এই ধরনের পুথির মোঙ্গোলীয় অনুবাদ হয় (Kvaerne, p 3 & footnote 25 at p. 269)।



[ads id="ads2"]



তবে এই যুক্ত সংকলনের পুথিগুলি হাতে লেখা বলেই বিভিন্ন পুথির মধ্যে আনুপূর্বিক অভিন্নতা ছিল না। যেমন, তিব্বতী অনুবাদের পুথিতে ৫০ নং চর্যার ‘তইলা বাড়ির... ফুলিআ’–এই চরণদুটির পাঠ ও টীকার অনুবাদ নেই। মনে হয় তিব্বতী অনুবাদক যুক্ত সংকলনের যে পুথি ব্যবহার করেছিলেন তাতে এই চরণদুটি ও তার টীকা ছিল না। সুতরাং শাস্ত্রী-আবিষ্কৃত পুথিটি সটীক চর্যাগীতির একমাত্র পুথি নয়, অন্যতম পুথি। তবে শুধু সেই অন্যতম পুথিটিই আমাদের হস্তগত হয়েছে।

মন্তব্যসমূহ