কাহ্নপাদ বা কৃষ্ণপাদ
অধিক সংখ্যক পদের রচয়িতা
চর্যাগীতিতে সঙ্কলিত ৫০টি গানের ভিতর ১৩টি গানই কাহ্নপাদের রচনা। ২৪ সংখ্যক চর্যাটি মূল পুথিতে লুপ্ত, কাজেই মােট ১২টি গান (চর্যা ৭, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৮, ১৯, ৩৬, ৪০, ৪২, ৪৫) কাহ্ন ভনিতায় পাওয়া যাচ্ছে। চর্যাগীতিতে সংখ্যার দিক থেকে কাহ্নের রচনাই সর্বাধিক। তিব্বতী ইতিহাসে, তাঞ্জুর তালিকায়, চর্যাগীতিতে এবং বাংলা সিদ্ধাচার্য গীতিকায় কাহপাদ একটি বিশিষ্ট নাম।
তিনি সিদ্ধ সাধক, মহাপণ্ডিত এবং মণ্ডলাচার্যদের ভিতর মহাচার্য। কাহ্নপাদ নিঃসংশয়ে কীর্তিমান, কিন্তু তাঁর একক ব্যক্তিত্ব ও জীবৎকাল তর্কাতীত নয়। তাঞ্জুর তালিকায় কৃষ্ণ, কাহ্নপাদ, কৃষ্ণপদ, কৃষ্ণবজ্রের নামে যে গ্রন্থতালিকা সন্নিবেশিত হয়েছে, তাতে একাধিক কৃষ্ণ থাকতে পারেন, সেরূপ সঙ্কেত পাওয়া যায়।
[ads id="ads1"]
কাহ্ন একজন না দুইজন ?
ডঃ সুকুমার সেন বলেন, “চর্যাগীতিতে যে গানগুলি আছে, তাহা হইতে অন্ততঃ দুইজন কাহ্নের অনুমান করিতে পারি।" তিনি মনে করেন, ১০, ১১, ১৮, ১৯, ৩৬, ৪২ সংখ্যক চর্যা জালন্ধরীপাদের শিষ্য তান্ত্রিক যােগী কাহ্নের রচনা এবং ৭, ৯, ১২, ১৩, ৪০, ৪৫ চর্যা অপর কাহ্নের রচনা। চর্যাগানে একই সাধকের দুই শ্রেণীর গান পাওয়া যায়--এক শ্রেণীতে পড়ে সহজ মহাসুখ তত্ত্ব এবং স্বসংবেদনের কথা, অপর শ্রেণীতে পড়ে সেই সহজ মহাসুখ লাভের উপায়ের কথা। সহজসাধনের এই উপায় রহস্যময় তান্ত্রিক যােগ। তা গূঢ়, জটিল ও সন্ধ্যা-সংকেতে পূর্ণ। ডঃ সুকুমার সেনের শ্রেণীভাগ অনুসারেও দেখা যাবে দুই শ্রেণীর ভিতর ভাবগত ও ভাষাগত মিল প্রচুর রয়েছে। তাই জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী 'চর্যাগীতির কৃষ্ণ বা কাহ্নপাদ এক ও অভিন্ন' বলে মন্তব্য করেছেন।
বিভিন্ন ভণিতা
চর্যাগীতিতে টীকায় রচয়িতার যে নামগুলি পাওয়া যায়, তাতে
- কাহ্নপাদ (৭, ৯, ৪০, ৪২, ৪৫),
- কৃষ্ণপাদ (১২, ১৩, ১৯),
- কৃষ্ণাচার্যপাদ (১১, ৩৬),
- কৃষ্ণপবজ্রপাদ (১৮) প্রভৃতি নাম দেখা যায়।
কাহ্নপাদের পরিচিতি
কাহ্নপাদের পরিচয় পুরাণশ্রুতিতে আচ্ছন্ন। তাঞ্জুর তালিকায় কখনও বলা হয়েছে, তিনি ভারতবাসী, কখনও বলা হয়েছে তিনি উড়িষ্যা থেকে এসেছেন। তিব্বতের প্রাচীন ইতিহাস বলে, কৃষ্ণচারী কর্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেন। জনশ্রুতি এও বলে, তাঁর জন্মস্থান পদ্মনগর বা বিদ্যানগর বা বিজয়নগর। এই স্থানগুলি কোথায়, তাহ নিরূপণ করা অসম্ভব। বাংলা সিদ্ধাচার্য-গীতিকা থেকে তাঁর একটি কীর্তি-কেন্দ্র যে বঙ্গ মেহারকুল, তা জানা যায় । কাহ্নপাদের গানে বাংলা শব্দ সম্ভারের প্রাচুর্যও লক্ষণীয়।
কাহপাদের জীবন অতি বিচিত্র। প্রথমে তিনি ছিলেন সিদ্ধাচার্য বিরূপ বা বিরুপার শিষ্য। ভবিষ্যদ্বাণী হয়, তিনি চারটি মহাপাপ করবেন। ভবিষ্যদ্বাণী সফল হয়। পাপক্ষালণের নিমিত্ত তিনি জালন্ধরী পাদের শরণ গ্রহণ করেন এবং জালন্ধরীর নির্দেশে বজ্রবারাহীর উপাসনা করে পাপমুক্ত হন।
বিরূপের সঙ্গে যে কৃষ্ণপাদের যােগ ছিল, চর্যাগানে তার ইঙ্গিত আছে। ১৮ নং চর্যায় ডোম্বীর উদ্দেশে "বিরুআ' শব্দটিও আছে। তবু জালন্ধরীপাদের সঙ্গে কাহ্নের যােগ বেশী। বাংলা সিদ্ধাচার্য্য গীতিকায় জালন্ধরীপাদ 'হাড়িপা' নামে পরিচিত। চর্যাগানে কাহ্নপাদ জালন্ধরী-পাদকেই সাক্ষ্য মেনেছেন, 'শাখি করিব জালন্ধরী পাএ’ (৩ নং)। তিব্বতী ইতিহাসে আছে, জালন্ধরীর শ্রেষ্ঠ শিষ্য কৃষ্ণ অঙ্গে হাড়ের মালা ও হস্তে ডমরু ধারণ করবেন। চর্যাগানে (১০ ও ১১ নং) এর উল্লেখ আমরা পাই।
আলোচনা
চর্যাগীতির কাহ্নপাদ একাধারে চর্যাধর, সিদ্ধ সাধক ও কবি। কাহ্নপাদের গীতে কবিত্ব আছে, নাটকীয়তা আছে, আছে ছােট গল্পের দীপ্তি ও লােকচরিত্রের সমালােচনা।
[ads id="ads2"]
গৌড়বঙ্গের সমাজ-চিত্র উদ্ঘাটনের দিক থেকে কাহ্নপাদের কয়েকটি গান অমূল্য ঐতিহাসিক উপাদান। সমাজে ডােম্বীর স্থান, তাদের জাতিগত বৃত্তি ও স্বভাব এবং বিবাহচিত্র—বঙ্গ-ইতিহাসের একটি দিকে আলােকসম্পাত করেছে। তাঁর কবি-দৃষ্টিও শিল্পীর মত স্বচ্ছ ও সুন্দর। কাহ্নপাদের গানে ছন্দ-বৈচিত্র নেই—সবই ১৬ মাত্রার ছন্দ। রাগ-রাগিণীর বৈচিত্র্য আছে-- দেশাখ, গউড়া, ভৈরবী, কামােদ প্রভৃতি। গানে ভনিতার প্রাচুর্যও লক্ষণীয়। ডোম্বী, মত্ত গজেন্দ্র ও দাবা খেলার রূপকগুলি উপভােগ্য। ৪২ সংখ্যক গানের দৃষ্টান্ত বাক্যগুলিও অলঙ্কার যােজনায় সাধক-কবির কবি-প্রতিভার স্বাক্ষর।
সাহায্য : জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন