১
খোশবাসপুর গ্রামের এই বাড়িতেই আমি জন্মগ্রহণ করেছিলুম এবং জন্মের পরেই দেখেছিলাম চারপাশে শুধু পত্রপত্রিকা আর বইয়ের স্তূপ। এরই মধ্যে বড় হয়েছিলুম। মাকে দেখতাম উঠোনে বসে এই বাড়িরই পেয়ারা গাছের তলায় বিকেলে হাঁটুর উপর কাগজ রেখে কবিতা লিখতেন, গল্প লিখতেন বা প্রবন্ধ লিখতেন। দেখাদেখি আমারও লিখতে ইচ্ছে করতো এবং আমিও ততদিনে লেখাপড়া খানিকটা শিখেছি, লিখতে পারি। লুকিয়ে লুকিয়ে বাবার বইয়ের সংগ্রহ থেকে একটা বই একদিন পড়ে ফেললাম, তার নাম ‘অনন্তপুরের গুপ্তকথা’। সেই বইটা পড়ে আমার হঠাৎ খেয়াল হলো যে,আমিও একটা ওইরকম গুপ্তকথা লিখি। লিখে ফেললাম ‘খোশবাসপুরের গুপ্তকথা’; বেশ কয়েক পাতা লিখে ফেললাম, এই ভাবেই আমার প্রথম লেখা জীবন খুব অল্প বয়স থেকেই শুরু হয়েছিল। আর এই বাড়ি এইখানে এই পরিবেশে আমি যে মানুষ হয়েছিলাম সেখানে অনেক কিছু ভাল লাগার মত ছিল। পাঁচিলের ধারে ধারে সুন্দর ফুলের গাছ এবং সেই গাছের ভেতরে আমি খেলাঘর করতাম, পেছনের দিকের বাগানে গিয়ে আমি সারাদিন সময় থাকলে ছুটি থাকলে খেলাধুলো করে বেড়াতাম। এটা একেবারেই ছোট বয়সের ঘটনা। একটা বেজিও দেখেছিলাম, একবার একটা খরগোশও। এইরকম পরিবেশ ছিল তখন গ্রামে।
সাহিত্যের উপকরণ যেমন আমি সংগ্রহ করেছিলাম আমার পারিবারিক পরিবেশ থেকে, তেমনি তারও বেশি সংগ্রহ করেছিলাম প্রকৃতি থেকে এবং সে প্রকৃতি অত্যন্ত আদিম ভয়াল এবং জৈব। তার অভ্যন্তরে গেলে অনেককিছু দেখা যায়, পাখির বিষ্ঠা ছত্রাক শ্যাওলা সাপের খোলস --এইসব আদিম প্রাকৃতিক জিনিস তার ভাষা নিয়ে সেখানে শুয়ে থাকে এবং সেই ভাষাকে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম। সেই ভাষাকে রূপ দিতে চেষ্টা করেছি মানুষের ভাষায়। প্রকৃতির অভ্যন্তরে যে ভাষা সতত প্রবহমান, আমাদের জীবনকে যে প্রবাহ ধরে রেখেছে তার সঙ্গে একাকার করে মিশিয়ে দিতে চেয়েছিলাম আমার সমস্ত লেখায়।
আমি যখন লিখতে শুরু করেছিলাম তখন আমার সামনে কোন নির্দিষ্ট সমাজ বা সম্প্রদায় বা কোন বিশেষ গোত্রের পাঠক কারো কথা ভাবিনি, আমি লিখেছিলাম নির্বিশেষ পাঠকের জন্যে; অন্নদাশঙ্কর যাকে বলেছেন যে ‘অন্তিম পাঠক’ সেই পাঠকই ছিল আমার লেখার সামনে।
ছোটবেলা থেকেই আমার বোহেমিয়ান স্বভাবটা ছিল। তাই স্কুল পালিয়ে পরবর্তীকালে কলেজ পালিয়ে কোথায় কোথায় যে চলে যেতাম কিন্তু একটা ব্যাপারে আমার নিবিড় নিষ্ঠা ছিল সেটা হলো, সাহিত্য সংস্কৃতির জগতের নামকরা লোকেদের সাথে পরিচিত হওয়া। তো সেই সুযোগও আমি ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সঙ্গে থেকে সুযোগ পেয়েছি। বহুবার আমি কলকাতায় এসেছি এবং তখন কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল। তো তখনই আলাপ হয়ে যায় গণনাট্য সংঘের অনেক শিল্পীদের সঙ্গে। আর ছেলেবেলা থেকেই আমার একটা স্বভাব ছিল বাঁশি বাজানোর, এই বাঁশি আমি বাজাতাম সবসময়ই এবং আমার পিঠে কোমরের দিকে বাঁশিটা গোঁজা থাকতো। আমি যখনই কলকাতায় এসে বেগবাগান রো’তে IPTA-র ডেরায় আসতাম, তখনই অনেকদিন দেখেছি সলিল চৌধুরী হঠাৎ ঘরে ঢুকলেন, ঢুকে আমার পিঠের ভেতর থেকে টেনে নিতেন বাঁশিটা, নিয়ে বাজাতে শুরু করতেন। তো এই ভাবেই চলছিল দিন। ১৯৫০ সালে বিএ পাস করার পর হঠাৎ খেয়াল হলো যে সব ছেড়েছুড়ে আমি কলকাতায় চলে যাই আমাকে কবি হতেই হবে।
আমাকে তখন গণনাট্য সংঘের পক্ষ থেকে লোকসংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়ার একটা প্রবণতা দেখা দিয়েছিল সেই প্রবণতা অনুসারে আমাকে মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির আমি ছিলাম কর্মসমিতির অন্যতম সদস্য, আমাকে বিশেষ করে সম্পাদক ছিলেন রুনুদা (সুধীন সেন), উনি বললেন যে, তুমি তো গ্রামের ছেলে গ্রামে মানুষ হয়েছো। আলকাপ লোকসংস্কৃতি তখন জনপ্রিয়, আমি আলকাপ দলের সঙ্গে মিশে গেলাম।
২
আমার প্রথম যৌবনের দিনগুলোতে আলকাপ ছিল লোকসংস্কৃতি জগতে জনপ্রিয় নাট্য অনুষ্ঠান। আমি ঘটনাচক্রে সেই আলকাপের দলে শিল্পী হয়ে ঢুকে পড়ি এবং তারপর কেটে যায় আমার সেই শিল্পের মায়ায় ৬০ হাজার ঘন্টা এবং সেই সাথে ঘন্টার মায়া আমাকে এমন আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে, পরবর্তীকালে আলকাপ তো উঠে গেছে, এখন ‘পঞ্চরস’ বলে একধরনের নাট্যরীতি চালু আছে, সে আলকাপ নেই কিন্তু তবু সেই সময়কার সেই স্মৃতি সেই আলকাপের মায়া সেই আলোকিত রাত্রির আসর; আমার কলকাতা জীবনে এখনও স্বপ্নে হানা দেয়, বারবার আমাকে আঘাত করে এবং আমার মনটা কেমন করে ওঠে।
দীর্ঘ প্রায় ৬ বছর ধরে আলকাপ লোকনাট্যের সঙ্গে জড়িত থেকে আমি ক্রমশ ক্লান্ত হয়ে উঠেছিলুম। তারপর বাড়ি ফিরে এলাম। তারপর আমার জীবনে ঘটল একটা আকস্মিক পট পরিবর্তন; ঈষৎ পূর্বরাগের পর হাসনে আরা নামক এক ষোড়শীর সঙ্গে আমার বিয়ে হলো এবং সে আগে থেকেই জানতো বা আমিও জানিয়ে ছিলাম যে, আমি একজন সাহিত্যিক। সে বিয়ের পর সেই প্রমাণ দাবি করে বসলো। এবং তাঁকে সেই প্রমাণ দেওয়ার জন্যই জেদ করে এক বছর ধরে একটা বিশাল উপন্যাস লিখলাম ‘কিংবদন্তীর নায়ক’।
অভিজ্ঞতা থেকে উপাদান কুড়িয়ে গল্প লিখি বলে কোনো কোনো সমালোচক আমাকে বলেছেন, তারাশঙ্করের সমগোত্রীয়। কিন্তু তারাশঙ্কর তো হিমালয়, আমি তাঁর কাছে নিতান্ত উই ঢিপির বেশি কিছু নই।
আমাদের জীবনে স্তূপীকৃত জ্ঞান, সেই জ্ঞানকেই আমরা অভিজ্ঞতা বলি। অভিজ্ঞতা থেকে কোনো এক টুকরো উপাদান কুড়িয়ে নিয়ে প্রকৃতপক্ষে আমি যা করি তা জ্যাঁক দরিদা কথিত ‘বিনর্মাণ’ বা ‘De-construction’. এবং এই করতে করতে এই টুকরোগুলো ছিন্নভিন্ন করার প্রক্রিয়াটাই হচ্ছে শিল্প এবং তা থেকে গড়ে উঠছে একটা আখ্যান তারপর আখ্যানমালা। সেইটিই হচ্ছে আমাদের যাকে বলা হয় ফিকশন বা গল্প বা উপন্যাস। আর এই ডি-কন্সট্রাকশন পদ্ধতিতেই আমি জীবনের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা থেকে উপাদান কুড়িয়ে তাকে ছিন্নভিন্ন করে ‘অলীক মানুষ’ নামে যে উপন্যাসটি আমি লিখেছিলাম, আমি সেই উপন্যাসটির থেকে ‘সাহিত্য অকাদেমি’ পুরস্কার পেয়েছিলাম।
ধর্ম নিয়ে আমি মাথা ঘামাই নে। আমার লেখার প্রয়োজন অনুসারে আমি যে থিম ভেবেছি সেই থিমকে লেখায় রূপ দেবার জন্যে আমি মানুষের কথাই চিন্তা করি। আমি হিন্দু মানুষ বুঝি না, মুসলমান মানুষ বুঝি না, খ্রিস্টান মানুষ বুঝি না; আমি বুঝি মানুষ এবং এই মানুষ প্রকৃতির সন্তান। যে মানুষদের আমি ঘনিষ্টভাবে নিবিড় করে চিনি, আমি তাদের কথাই লিখি। এবং আরো বলছি, যে প্রকৃতির সন্তান বলে জেনেছি মানুষকে সেই তার রূপ দেবার জন্যে আমার মনে একটা দার্শনিক প্রত্যয় জন্মে গেছে অনেকদিন ধরে। আমার মনে হয়েছে, যে প্রকৃতিই শ্বাশ্বত, প্রকৃতিই ঈশ্বর, প্রকৃতিই সমস্ত কিছুর পিছনে আছে। এবং প্রকৃতিই আমার সবকিছুর মূলে। এবং আমার এই যে দৃষ্টিভঙ্গি, এটা পরিপুষ্ট করার পিছনে আমার স্ত্রী হাসনে আরা যাকে আমি টুনু বলে ডাকি, সেই টুনুর অবদানকে আমি অস্বীকার করব না কিছুতেই। কারণ আমার এই ধারণাকে দিনের পর দিন পরিপুষ্ট করতে এবং বিশ্বাস করাতে সেও কিন্তু আমার পেছনে থেকেছে এবং আমি যখন কোনো কিছু নিয়ে দ্বিধান্বিত হয়েছি তখন শুধু সে বলেছে, ‘তুমি মানুষের কথা ভেবে লেখ, তুমি তো প্রকৃতিকে জানো এবং সেও জানে।’ টুনুও জানে কারণ আমার সঙ্গে বিয়ের পর আমরা প্রকৃতির মধ্যে ঘুরে বেড়িয়েছি, নদীর ধারে, মাঠে নানা জায়গায় আমার ছিল তাঁকে নিয়ে বেড়াবার একটা অবাধ বিচরণ ভূমি, যেখানে প্রকৃতিই বড় প্রকৃতি ছাড়া আর কিছু নেই। এবং সেই বোধ থেকেই আমার সমস্ত কিছু লেখা আজ গড়ে উঠছে এটার জন্যে আমি টুনুর কাছে ঋণী।
৩
ছোটবেলা থেকেই আমি ছিলাম একজন অ্যাডভেঞ্চারার, অ্যাডভেঞ্চারার বললেই আমাকে চলে কারণ আমি খুব দুর্গম এবং যেসব জায়গায় লোকে সচরাচর যায় না, সেইসব জায়গায় আমি ঘুরে বেড়াতাম। আমার দ্বারকা নদীর অববাহিকায় যে বিস্তীর্ণ জলাশয় এবং যে জঙ্গল ছিল, সেই জঙ্গলের মধ্যে আমি ঘুরে বেড়িয়েছি। এবং এই জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কত কী অভিজ্ঞতা হয়েছে। এর পরের জীবনে আমি যখন লেখক হয়ে উঠি তখন একসময় ‘অমৃত’ পত্রিকার কবি মণীন্দ্র রায় সম্পাদক ছিলেন, আমাকে বললেন যে, ‘একটা উপন্যাস লেখ। ছ’মাসের মধ্যেই ছোট উপন্যাস হওয়া চাই।’ তা ৬ মাস ধরে একটা উপন্যাস খুব ছোটও হবে না, আমি লিখতে শুরু করি। এমন সেই উপন্যাস লিখতে গিয়েই একটা খুনোখুনির কান্ড হয়ে যায় এবং তারপরেই আমি নিয়ে আসি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার নামে এক ডিটেকটিভ, ঠিক ডিটেকটিভও নন, তিনি ছিলেন প্রকৃতি বিজ্ঞানী। এবং সেই সঙ্গে তিনি অপরাধ রহস্যেরুও উন্মোচন করতে খুব ভালো বাসতেন। এই চরিত্রটি আমি পেয়েছিলাম আমার বিবাহিত জীবনের প্রথম হনিমুন করতে গিয়ে বলা যায়। একটি মানুষকে দেখেছিলাম ওইরকম চেহারার, তিনি কর্নেল ছিলেন কিনা জানি না। কিন্তু তিনি আমার মনে গাঁথা ছিলেন। তাই যখন মণীন্দ্র রায় আমাকে বললেন উপন্যাস লিখতে এবং খুন হয়ে গেল একটা, তখন আমি তাঁকে প্রথম এই কর্নেল হিসেবে নিয়ে এলাম। এবং এরপর ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকায় যখন কর্নেলকে নিয়ে উপন্যাস লিখছি, হঠাৎ একদিন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী আমার নীরেনদা যিনি সম্পাদক, তিনি বললেন, ‘ওরে লেখাটা খুব ভালো করে শেষ করবি, দুটো সংখ্যা জুড়ে একটা উপন্যাস বেরুছে।’ তা কেন? না ‘সত্যজিৎ রায় তোর লেখা খুব আগ্রহ দিয়ে পড়েছেন এবং উনি খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন।’ আমি বললাম, বলেন কি ! এর কিছুদিন পর হঠাৎ সত্যজিৎ রায়ের একটা চিঠি এসে আমার কাছে হাজির। রূপক চট্টরাজ নামে একটি ছেলে সে আমার কাছে একটা চিঠি দিয়ে গেল। সেই চিঠিতে সত্যজিৎ রায় আমাকে অনুরোধ করেছেন এবং তাঁর মতো মানুষ আমার মতো একজন সামান্য লেখককে কী বিনীতভাবে অনুরোধ করেছেন সেই চিঠিটি না দেখল্বে বোঝা যায় না! ‘সবিনয় নিবেদন’,‘সমীপেষু’ ইত্যাদি ইত্যাদি বলে আপনার সময় হবে তো, পারবেন তো –এইভাবে এইধরনের চিঠিটি লিখে ‘সন্দেশে’র জন্য শারদীয়া সংখ্যায় একটি লেখা প্রার্থনা করলেন। প্রার্থনা করা যাকে বলে। আমি অভুভূত হয়ে আমি কর্নেলের চরিত্র নিয়ে একটা উপন্যাস লিখলাম ‘টাক এবং ছড়ি রহস্য’। যখন কাগজটি বেরুল তখন দেখলাম, যে সত্যজিৎ রায় নিজেই কর্নেলকে এঁকে দিয়েছেন।
১৯৮০ সালের জুন মাসে হঠাৎ আমার কাছে আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটা আমন্ত্রণপত্র এল। তখন আমি আনন্দবাজারে কর্মরত সাংবাদিক। আমাকে ওরা আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে চার মাসের জন্যinternational Writing Programme -এ অন্তর্ভুক্ত করে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন অংশগ্রহণের জন্যে। আমি পাসপোর্ট ইত্যাদি তৈরি করা সব হয়ে গেল, আমি আগস্ট মাসের শেষে ওখানে রওনা হলাম। মধ্যে লন্ডনে একদিন ছিলাম। সেই আমার প্রথম অতদূর যাওয়া। তারপর সেখান থেকে অবশেষে আইওয়া পৌঁছলাম তখন আমার মনে হল যে আমি একটা সত্যি নতুন দেশে এসেছি। কারণ, সব কিছুই আমার কাছে নতুন মনে হচ্ছে। এত নিখুঁত মনে হচ্ছে সবকিছু। তারপর দেখলাম যে, বিয়াল্লিশটি দেশের লেখক তাঁরা সেখানে এসেছেন ইন্টারন্যাশানাল রাইটার প্রোগ্রামে যোগ দিতে। সেখানে আমি অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, বিশেষ করে আমার প্রতিবেশি ছিলেন ইব্রাহিম আনু সিনহা, উনি কায়রোর লোক। এবং আইওয়া ইউনিভার্সিটি ত আন্তর্জাতিক ইউনিভার্সিটি, সেখানে নানা দেশের ছাত্ররা পড়ে, তারফলে ওঁদের সঙ্গে পরিচয় হয়ে আমি যদিও সংস্কৃতের ছাত্র, আমি আরবি পড়িনি বা আরবি জানি না কিন্তু আরবিগুলো তো শব্দ জানতাম ছোটোবেলা থেকে। সেই শব্দগুলোর প্রকৃত উচ্চারণ আমি কিন্তু শিখে নিয়েছিলাম। এছাড়া লাতিন আমেরিকার যে সমস্ত কবি এবং ঔপন্যাসিক গিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ঘনিষ্টতা হয়েছিল বিশেষ করে ভেনেজুয়েলার মারিয়েলার কথা বিশেষ করে মনে পড়ে, সে আমাকে একটা বই উপহারও দিয়েছিল। সব সময় আমার কাছে আমার দেশের কথা জানতে চাইত। আর এর কথা না বল্লেই নয়-- ব্রাজিলের মহিলারা নাকি খুব জাঁদরেল হন। দজ্জাল। এই নিয়ে জনৈক কবি নাম লিয়ানি দ্য সান্তোস, লিয়ানির সঙ্গে একটু ঘনিষ্টতা হয় এবং লিয়ানি আমার কাছে জেনে খুশি হয় যে, পোর্তুগিজ শব্দ আমাদের বাংলা ভাষায় অজস্র আছে। তারপর সর্বদাই আমার সঙ্গে দেখা হলে বলত ‘Iwo j’ambo’, আমি বললাম, কি বলত চাইছ তুমি? ‘আই লভ ইউ।’
আমি তো অসংখ্য উপন্যাস লিখেছি কিন্তু আমার নিজের কাছে সবচেয়ে প্রিয় এবং সবচেয়ে বিস্ময়কর যে উপন্যাস তার নাম কিন্তু ‘জানমারি’। এই উপন্যাসটা হয়ত খুব কম পাঠকই পড়েছেন কিন্তু এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শুধু নয়, আরও অনেক অন্তরঙ্গ একটা ক্ষেত্র। সে ক্ষেত্রটি হল আমার মা। ন’বছর বয়সে আমি মাতৃহারা হয়েছি, আমার মা আনোয়ারা বেগম; তিনি লিখতেন নানা পত্রপত্রিকায়। কিন্তু এটা তাঁর পিত্তৃদত্ত নাম নয়, তাঁর নাম ছিল মরিয়ম বেগম। Jesus Christ যাঁকে বলা হয় মুসলমানদের মধ্যে, যে ইনি ‘ইসা পয়গম্বর’ অর্থাৎ Jesus Christ ‘ইসা পয়গম্বর’ মুসলমানদের কাছে। এবং আমি আমার সেই বাউন্ডুলে জীবনের সময় একটি লোককে কোনো একটি গ্রামে দেখতে পাই, যাঁর আচরণ ভারি অদ্ভূত, তাঁকে লোকে বলত ‘চোতপাগলা’। ‘চোতপাগলা’ একটি আঞ্চলিক শব্দ যার অর্থ ‘যার পুরো জ্ঞান আছে অথচ একটু আচরণের সময় পাগলামি প্রকাশ পায়’। এইরকম একটি লোক তাঁকে আমি আবিষ্কার করেছিলাম, যে অন্যের কাজ করে দেয় আবার নিজেকে বলে মুনিস খাটা। এই মুনিস খাটা লোকটি গানের সুরে বলত, ‘আমি মৈরমের ব্যাটা/ আমার নাই চাটি পাতা/আমার ঘর জগৎ সংসার।’ কিন্তু এই যে লাইনটি সেটা কিন্তু বাইবেলেও আছে এবং কোরানেও আছে। যিশু খ্রিস্ট বা ইসা পয়গম্বর নিজেকে বলতেন, ‘আমি মরিয়মের সন্তান, সবার ঘর আছে পৃথিবীতে আমার কোনো ঘর নেই।’ এই যে আমার নিজের মনের কথাও তাই। আমার সত্যি নিজের কোনো বাসস্থান নেই, আমার কিছু নেই, আমি মরিয়মের ব্যাটা। এই যে মরিয়মের ব্যাটা বলতো যে লোকটি আধপাগলা তাকে ঘটনাচক্রে, অত্যন্ত সরল ভালোমানুষ সে, ভালোমানুষি করতে গিয়েই অতর্কিতে খুন হয়ে যায়। এই ঘটনা দেখার পর থেকে আমি আমার মনের মধ্যে তাঁকে একটা জায়গা দিয়েছিলাম, দাঁড় করানো ছিল। হঠাৎ শারদীয়া লেখার সময় হাতের কলম দিয়ে বেরিয়ে আসে। এটি আঞ্চলিক টার্ম ‘জানমারি’, যারা মানুষকে মারে অথবা মারা হয়-- ‘জানমারি’ এই অর্থে ব্যবহার হত। সেই নিষ্ঠুর জানমারিদের হাতে সেই লোকটিকে মারা হয়েছিল আমিও উপন্যাসে সেটিকে দেখিয়েছি যেন, হজরত ইসা পয়গম্বর বা যিশু যেন বারবার মর্ত্যে ফিরে আসছেন, তাঁর পুরুত্থান ঘটছে এবং তিনি ক্রুসিফায়েড হচ্ছেন। শেষের দৃশ্যে আমি দেখিয়েছি, যে এই লোকটিকে ধরে নিয়ে গিয়ে ক্রুশ কাঠে বিদ্ধ করা হচ্ছে, কবরের মধ্যে ক্রুশ কাঠ বয়ে নিয়ে গিয়ে ক্রুশ কাঠে তাকে বিদ্ধ করা হচ্ছে, তখন সে চিৎকার করে বলেছে ‘ইলি ইলিল্লাস লামা সা বক্তানি’-- এটা বাইবেল থেকে বলা যে, ‘ঈশ্বর, হে আমার ঈশ্বর তুমি কি আমাকে পরিত্যাগ করলে’। এটি বাইবেলে আছে। এটি দিয়ে আমি উপন্যাসটা শেষ করেছি। এই লেখাটি আমার নিজের কাছের মনের লেখা এবং আমি ত সত্যিই তাই । আমি মরিয়মের ব্যাটাই বটে, মরিয়মের পুত্র, মরিয়মের সন্তান। আমি ইসা নই কিন্তু আমার ঘর সংসার নিজের নামে নেই, আমি চিরদিন বাউন্ডুলে, চির ভ্রমণ করে বেড়াই, দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরেছি।
----------------------------------------------------
Based on a Documentary Named
‘Unreal Man Real Artist’
By KG Das
Sahitya Akademi
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন