সংগ্রামী রাসবিহারী বসু ও এক জাপানি কন্যার প্রেমকথা (লেখক : কল্যাণ চক্রবর্তী)



 

স্বাধীনতা সংগ্রামী রাসবিহারী বসুর বিবাহ

লেখক : কল্যাণ চক্রবর্তী


পার্টিতে এসেছেন কেস্টু-বিস্টুরা। কে ওই মেয়েটি ?  অসাধারণ সুন্দরী, লাবণ্যময়ী। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। দুচোখে উপাসনা মন্দিরের স্নিগ্ধতা। নরম সূর্যের আভা দুটি গালে। যুবকটি তখনও জানে না, আজাবুতে এই মেয়েটিই যোগাযাযোগের মাধ্যম ছিল। ব্রিটিশ পুলিশের সন্দেহ হয়নি। দুজনের কখনওই সাক্ষাৎ হয়নি। মেয়ের মাও মেয়েকে আগলে রাখতেন। মেয়ের জীবনে ছবি আঁকিয়ের উপস্থিতি তাঁর অজানা নয়। শিল্পীর নাম ৎসুনে নাকামুরা। পনেরো বছরের স্কুল ছাত্রীটির নগ্ন ছবি এঁকে ইতিমধ্যেই সাড়া ফেলেছেন শিল্পী। নুড ইমেজ অব এ গার্ল, এ ফিমেল ইমেজ, এ গার্লস প্রভৃতি ছবি নজর কেড়েছে জাপানে। সন্ধ্যা প্রদীপের আলোয় শিল্পীকে মনও দিয়ে ফেলেছিলেন পঞ্চদশী। মা মান্যতা দিলেন না সেই অসময়ের ভালোবাসাকে। কারণ, শিল্পী কাশলেই মুখ দিয়ে রক্ত উঠে আসছে। মৃত্যুপথযাত্রী কখনওই মেয়ের কাক্ষিত হতে পারে না। ফিসফিসিয়ে কেউ কেউ বলে, মা'রও দুর্বলতা ছিল চিত্রীর প্রতি। ভারতীয় যুবকটির সাহসী জীবনে কখনও এত কাছ থেকে রোমাঞ্চের ইশারা আসেনি। জীবনে সে ভালোবাসার সীমানা দেখেনি। ভাইসরয়কে বোমা ছোঁড়া ডাকাবুকো যুবক প্রথমবার দেখল একটি শান্ত মুখশ্রী। যুবকটির সুপ্ত ব্রতধারী মনে এল অমসৃণ চঞ্চলতা।

ভারতীয় যুবকটি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন অতিথি জাপানি মিত্রদের। ১২ মে (সাতসুকি) ১৯১৫ থেকে ১৯১৬র মার্চ (ইয়াওয়ি) পর্যন্ত অনেক ঝড়ঝাপটা বয়ে গেছে তাঁর প্রবাসী জীবনের ওপর দিয়ে। জাপানি বন্ধুরা আশ্রয় না দিলে কবে ব্রিটিশ ঘাতক বাহিনীর হাতে ঝাঁঝরা হয়ে যেতেন প্রিয়নাথ ঠাকুর। দেশ থেকে পালিয়ে আসার সময় এই নামের পাসপোর্ট ছিল তাঁর কাছে। দেশে চন্দননগরের কানাইলাল বিদ্যামন্দিরের ছাত্র হাজিরা খাতায় অবশ্য লেখা রাসবিহারী বসু। জন্ম বর্ধমানের সুবলদহ গ্রামে। ব্রিটিশ রাজশক্তির বুকে কাঁপন ধরানো নাম। জাপানে এই স্বাধীনতা সংগ্রামীকে আগলে রাখার দায়িত্বে আছেন ব্ল্যাক ড্রাগন সোসাইটির প্রাণপুরুষ মিচিরো তোইয়ামা। নিজের বিশাল সামুরাই সাম্রাজ্যের নিরাপদ আশ্রয়ে আগলে রেখেছেন তিনি। এই ভারতীয়কে বাঁচাবার একটিই উপায়, জাপানের নাগরিকত্ব এবং জাপানি বউ।

তোইয়ামা রাসবিহারীর বর্ম হিসাবে চাইলেন তোশিকোকে। সোমা পরিবারের একমাত্র মেয়ে। ধনী নাকামুরায়া কোম্পানির মেয়ে, আধুনিক ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিতা তোশিকা সোমা। অন্যদিকে বিনোদবিহারীর পুত্র কপর্দকহীন এক ভারতীয় যুবক। যার দেশে ফেরার কোনও সম্ভাবনা নেই। যে কোনও মুহূর্তে ব্রিটিশ ঘাতকেরা তার প্রাণের স্পন্দনকে থামিয়ে দেবে। আইজো সোমা আর কোকো সোমা বলেন, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমস্ত দায়ভাগ কি শুধু সোমা পরিবারের?

মা হিসাবে রাসবিহারীকেই বা উপেক্ষা করেন কেমন করে ? রাসবিহারী যে তাঁদের মা-বাবা বলে ডাকেন। 'মা, আমাকে বাঁচাতে গিয়ে তোমার কন্যাসন্তানকে তুমি হারিয়েছ, তাকে বুকের দুধটুকুও দিতে পারনি, আমাকে তোমাদের সন্তান হিসাবে গ্রহণ কর। কোকো সোমার কাছে এ যেন হৃদয় উপড়ে আসা আর্তনাদ। ব্রিটিশের টুঁটি ধরে যে তাঁরই সন্তান বাঁচতে চাইছে। যে কটাদিন ভারতীয় ছেলেটিকে নিজের আঁচলের তলায় লুকিয়ে রেখেছিলেন, তার কথায় তিনি শুনেছিলেন ভাষার লাবণ্য আর ঔদ্ধত্যের অতুলনীয় মিশেল। সহিষ্ণু ভারতবর্ষের সমন্বয়ের ছবি তিনি দেখেছেন এই ভারতীয় ছেলেটির মধ্যে। রাসবিহারী যে বুদ্ধের দেশের স্বাধীনতা প্রচেষ্টার চোখ ধাঁধানো কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু তাশিকো, তার কথাই বা উপেক্ষিত হয় কোন কারণে? তাশিকো এখনও স্কুল ছাত্রী। গার্লস স্কুল অব দ্য আমেরিকান ডিসাইপল চার্চের কোনও ছাত্রীরই যে এখনও বিয়ে হয়নি।

তোয়ামার তাগাদা আর ব্রিটিশের গোয়েন্দাদের আঁটসাঁট নজরদারির মধ্যে সোমা পরিবার তখন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। মা-ই কথাটা পাড়লেন মেয়ের কাছে। সব শুনে সময় চাইলেন তোশিকো। যার শরীরে মৃত্যু হাতের স্পর্শ লেগেছে, তাকে রোমান্সের আবহে ফিরিয়ে আনবে কেমন করে ? রোমান্টিক জীবনতো যুবকটির সামনে নেই। তার জীবন দেবতা ব্রিটিশের কাছে জীবন্ত দুঃস্বপ্ন। রাসবিহারী নামটাই ইংরেজ কুলের ত্রাস। মানুষটার জীবনটাই অদৃশ্যপূর্ব বীরগাথায় পূর্ণ। হ্যাঁ, তোশিকোই পারে তাকে তীর্থপথের শেষ ঠিকানায় পৌঁছে দিতে। মাকে জানায়, আমাকে রাসবিহারীর কাছে যেতে দাও। ওর মৃত্যুকে আমি মধুর করে দিতে পারি। সোমা পরিবারের মধ্যে তখন অবিশ্রান্ত তুফান। মা আবার বোঝালেন। রাসবিহারীর মুখে শুনেছেন নাগতনয় সুমুখ আর গুণকেশীর প্রেম কথা। হিংস্র গোরুড়ের মৃত্যু ফতোয়া মিথ্যে করে নিজের কুমারীত্ব উৎসর্গ করে সুমুখকে বাঁচিয়েছিল গুণকেশী। তার কামনার নিঃশ্বাসে মিথ্যে হয়েছিল গরুড়ের নিদেন। প্রেমের পুরুষকে পিপাসার শোণিতে মধুময় করে তুলেছিল মাতলি তনয়া। অবিচল তোশিকোও। এক মহা প্রাণময় কাব্য সৃষ্টির তাগিদ অনুভব করল তোশিকো। এত স্পষ্ট, স্বচ্ছন্দ, আবেগহীন কথা কোকো এর আগে মেয়ের মুখে শোনেননি। বিস্ময়াতুর দৃষ্টিতে চাইলেন মেয়ের দিকে। বিয়ের তারিখ ঠিক হল ৯ জুলাই (হাজুকি) ১৯১৮। মেয়ের বাড়ির কেউ থাকবে না একমাত্র উনিশ বছরের ভাই টিকাকো ছাড়া। অনুষ্ঠান হবে মিচিরো তোইয়ামার বাড়িতে। টোকিওর তাকাশিমায়া বহুজাত বিপণি থেকে এল মেয়ের জন্য কিমানো। কোকো রাসবিহারীকে প্রশ্ন করে জেনে নিয়েছেন, ভারতের তাঁর কোনও বাগদত্তা নেই। জাপানিদের মতো মেকাফে (রক্ষিতা স্ত্রী)-ও নেই। জাপানেও কোনও মেকাফে বা গেইসা (নর্তকী)-র নজর ভাবী জামাইয়ের ওপর তখনও পড়েনি।



rasbihari toshiko
রাসবিহারী ও তোশিকো


সুন্দর দেখাচ্ছে তোশিকোকে। শান্ত, নম্র। জাপানি মেয়েদের সাধারণত কুড়ি বছর পার হওয়ার পর বিয়ে হয়। তোশিকো সবে কুড়ি ছুঁয়েছে। হাকাতো পরেছেন রাসবিহারী। তোইয়ামার ঘরে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ঘেরাটোপ। দুজন সাক্ষী, শিনপেই গোতো, আর ৎসুইয়োশি, ইনুকাই। পিতা হিসাবে কন্যা সম্প্রদান করলেন তোইয়ামা। সহিষ্ণু ভারত বরণ করল আত্মনিবেদনে ভরপুর জাপানকে। প্রতিবেশির হর্ষধ্বনি নেই, বিস্কুট, কমলালেবু ছড়ানোর ব্যবস্থা নেই, নেই সেই কুড়িয়ে খাওয়া ছেলেগুলো। পাত্রে রাখা সাকো (জাপানি মদ)। রাসবিহারীর জন্য ওচা (জাপানি চা)। সাধারণত ঘরজামাইরা নিজেদের পদবি ছেড়ে মেয়ের পদবি গ্রহণ করে বাড়ির ছেলে হয় জাপানে। ব্যতিক্রম রাসবিহারী। ছাড়লেন না বসু পদবি। ইতিহাসের গুজবে কোনওদিনই প্রশ্রয় দেননি এই জন্ম বিপ্লবী। রক্তে তাঁর আধ্যাত্মিকতা, স্বপ্নে ভারতের স্বাধীনতা, কর্মে নীরব যোদ্ধার নষ্ট গদ্য এক রোমাঞ্চের মোড়কে মোড়া। অনাবিল মুগ্ধতায় যুবকের হৃদয় অঙ্কুরিত হয়ে উঠল। এরই নাম কি ভালোবাসা ? এই প্রথম এক জন্মযোদ্ধার জীবনে এল কাব্যিক স্নিগ্ধতা। কঠিন বস্তুনিষ্ঠ আবর্তের মধ্যেও চিরন্তনী নারীর প্রেম, শুচিস্মিত রম্যতা। এত লাবণ্যময়ী রূপ এই পালিয়ে বেড়ানো মানুষটি জীবনে দেখেননি। মধুচন্দ্রিমা শুরু হল শিবা অঞ্চলের আতাগোইয়ামার একটি নির্জন বাড়িতে। ব্রিটিশের শ্যেন দৃষ্টি খ্যাপার মতন তালাশ করে চলেছে। শান্ত তোশিকোকে দেখে রাসবিহারীর সংশয় যায় না। তোশিকো সর্বদা বিনয়াবনত, আত্মত্যাগী। স্ত্রীর স্পন্দনশীল রঙের দ্যুতি যেন কোথাও নিষ্প্রভ। আত্মপ্রকাশ নেই, নির্লিপ্ত এক সাধিকা। রাসবিহারীর কাছে ধোঁয়ার পরদা গাঢ় থেকে গাঢ় হতে লাগলো । নিজেকে মনে হল হেমন্তের এক প্রাণহীন নায়ক। বলেই ফেলেন, তুমি কি আমাকে ভালোবাস ? নির্লিপ্ত উত্তর ছোট কথায়, কী করলে বুঝবে ? আমার জন্যে মরতে পারো ? পাহাড়ের কোলে ছোট সে কাঠের দোতলা বাড়ির বারান্দা। ছুটতে শুরু করলেন তোশিকো। ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে আত্মহননই সহজ পন্থা। ভীত রাসবিহারী দৌড়ে জড়িয়ে ধরলেন স্ত্রীকে। অস্ফুট স্বরে মুখ দিয়ে একটি কথাই বার হল- আমাকে ক্ষমা করো। জাপানী সাধ্বী স্ত্রীর দৃপ্তা সিংহী রূপ দেখে লজ্জিত হলেন রাসবিহারী। মেয়েদের এই উদ্দীপ্ত তেজই চেয়েছিলেন রাসবিহারীর জীবন দেবতা স্বামী বিবেকানন্দ। নারী হৃদয়ের বেদনাকে মর্যাদা দিতে শিখলেন রাসবিহারী। এর পর থেকে শুরু হল বর্ণময় এক বিবাহিত জীবন।

সতেরোবার বাড়ি পাল্টাতে হল ব্রিটিশের নজর এড়াতে। রোজ সকালে স্বামীর সঙ্গে ভারতীয় মন্ত্র উচ্চারণ করেন তোশিকো। দুবছর পর মাসাহিদের জন্ম, একমাত্র মেয়ে তেৎসুকোর জন্ম তার দুবছর  পর। মাত্র আট বছরের দাম্পত্য জীবনের অমর কাহিনী লেখা হল না। এই রঙিন সম্পর্কের টুপটাপ বৃষ্টি সাধারণের অগোচরেই থেকে গেল। ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে দুটি নিবেদিত প্রাণের আবেগঘন মুহূর্তের ছবি আঁকা হল না। রাসবিহারী জাপানের নাগরিকত্ব পেলেন ১৯২৩-এ, ছাড়লেন চন্দননগরের ফরাসি নাগরিকত্ব। ১৯২৫ এর ৪ মার্চ স্বামীর জাপানের আশ্রয়কে নিশ্চিন্ত করে চলে গেলেন রাসবিহারী প্রাণা তোশিকো। প্রতিদিন সকালে যে সংস্কৃত মন্ত্র দু'জনায় উচ্চারণ করতেন, মৃত্যুর অন্তিম লয়ে, জন্মে জাপানি, মর্মে ভারতীয়, আঠাশ বছরের তোশিকো পাড়ি দিলেন অমৃতলোকে। এরপরও রাসবিহারী বেঁচেছিলেন আরও কুড়ি বছর। ১৯৪৫র ২১ জানুয়ারি (মুৎসুকি) সম্রাটের শকট রাসবিহারীকে বয়ে নিয়ে চলল তামা শ্মশানের দিকে দ্বিতীয় সূর্যপুত্রের মর্যাদায়। স্ত্রী শুয়ে আছেন সেখানে। শেষ ইচ্ছা ছিল প্রিয়তমা স্ত্রী'র সমাধির ওপর তাঁর সমাধি হবে। অনন্ত বাহুবন্ধনে আবদ্ধ থাকবে জাপান আর ভারত।


------------------------------------------------------------

তথ্য সহায়তা : লিপিকা ঘোষ, চন্দননগর হেরিটেজ

গবেষণা ও ছবি : রাসবিহারী রিসার্চ ইনস্টিটিউট ও দাইতো বুনকা ইউনিভার্সিটি

প্রকাশ -  সাপ্তাহিক বর্তমান, ১৮ আগস্ট ২০১৮

--------------------------------------------------------------------------------

মন্তব্যসমূহ