২১. নরহরি (সরকার)
পদাবলি সাহিত্যে নরহরি প্রধানত দুজন।
একজন ষোড়শ শতকের নরহরি সরকার। শ্রীখণ্ডের বৈদ্যবংশে এঁর জন্ম। পিতার নাম নরনারায়ণ
দেব ;
মাতার নাম গৌরীদেবী। বয়সে গৌরাঙ্গের চেয়ে চার-পাঁচ বছরের
বড় ছিলেন। ছাত্রাবস্থা থেকে নিমাই-এর সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। পরে গৌরাঙ্গের একান্ত ভক্ত হন এবং নবদ্বীপ নীলার অন্তরঙ্গ
পরিকর ছিলেন। পুরীতে রথযাত্রাকালে শ্রীচৈতন্য অনুবর্তী সপ্ত কীর্তন সম্প্রদায়ের
অন্যতম দলের নেতা হতেন নরহরি। সর্বপ্রথম তিনিই শ্রীখণ্ডে গৌরাঙ্গ পূজার প্রবর্তক।
চৈতন্য-বিষয়ক প্রথম বাংলা পদের রচয়িতা। রঘুনন্দন, লোচনদাস তাঁর শিষ্য। গৌরনাগরবাদের প্রবর্তক নরহরি সমসাময়িক নবদ্বীপ
বৈষ্ণবসমাজে কিছুটা উপেক্ষিত ছিলেন।
২২. নরহরি (চক্রবর্তী)
অপর নরহরি হলেন অষ্টাদশ শতকের নরহরি
চক্রবর্তী। পিতা জগন্নাথ চক্রবর্তী। কবি প্রথম জীবনে নবদ্বীপ থাকলেও পরে গার্হস্থ্য
ধর্ম ত্যাগ করে বৃন্দাবনে বাস করেন। ভক্তিরত্নাকর, নরোত্তমবিলাস, শ্রীনিবাসচরিত্র, গীতচন্দ্রোদয়, গৌরচরিত্রচিন্তামণি প্রভৃতি গ্রন্থের রচয়িতা নরহরি চক্রবর্তীর সংস্কৃত
সাহিত্যে ও ছন্দসঙ্গীতে গভীর ব্যুৎপত্তি ছিল। ঘনশ্যাম ও নরহরি উভয় ভণিতাতেই তিনি
পদ রচনা করেছেন।
২৩. নরোত্তম ঠাকুর
রাজশাহী জেলার গোপালপুর পরগণার
অধিপতি রাজা কৃষ্ণাদন্দ দত্তের পুত্র। মাতা নারায়ণী। পিতার মৃত্যুর পর
বিষয়-বিরাগী নরোত্তম পিতৃব্যপুত্র সন্তোষ দত্তকে রাজ্যভার দিয়ে বৃন্দাবনে লোকনাথ
গোস্বামীর শিষ্য হন। পিতৃ-রাজধানী খেতুরীতে আনুমানিক ১৫৮১ খ্রি. নরোত্তমের
চেষ্টায় এক ঐতিহাসিক বৈষ্ণব মহোৎসব হয়েছিল। প্রেমভক্তিচন্দ্রিকা, সিদ্ধভক্তিচল্দ্রিকা, রসভক্তিচন্দ্রিকা প্রভৃতি বহু গ্রন্থ তাঁর নামে প্রচলিত। নরোত্তম ছিলেন একজন
শ্রেষ্ঠ কীর্তন গায়ক। তাঁর প্রার্থনা পদগুলি সুবিখ্যাত।
২৪. নৃসিংহ
অষ্ট কবিরাজের অন্যতম বৈষ্ণব পদকর্তা
নৃসিংহ ষোড়শ শতকের শেষভাগে বর্তমান ছিলেন। এঁর উপাধি কবিরাজ। ভক্তিরত্নাকরের দশম
তরঙ্গে খেতুরীর মহোৎসব বর্ণনা প্রসঙ্গে নরোত্তম ঠাকুরের যে শিষ্যসঙ্গীবর্গের
বর্ণনা আছে সেখানে নৃসিংহ কবিরাজ ও তাঁর ভ্রাতা নারায়ণের নাম আছে।
নসির মামুদ
পরিচয় অজ্ঞাত।
-------------------------------------------------------------
বৈষ্ণব কবিদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় ১ম পর্ব
-------------------------------------------------------------
-------------------------------------------------------------
বৈষ্ণব কবিদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় ১ম পর্ব
-------------------------------------------------------------
২৫. বলরাম দাস
বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে একাধিক বলরাম
দাসের অস্তিত্ব বর্তমান। তার মধ্যে প্রেমবিলাস কাব্য রচয়িতা শ্রীখণ্ডবাসী
নিত্যানন্দ বলরাম নামে যেমন পদ লিখেছেন তেমনি ‘কৃষ্ণলীলামৃত’ কাব্য রচয়িতা দীন বলরামের পদ আছে। কিন্তু পদাবলীখ্যাত
মুখ্যতঃ দুজন। তার মধ্যে একজন দোগাছিয়া গ্রামের বলরাম দাস। ষোড়শ শতকের
প্রথমার্ধে এঁর জন্ম। নিত্যানন্দের নিকট ইনি দীক্ষিত হন। কবি ছিলেন কৃষ্ণের বালগোপাল
মূর্তির উপাসক।। বাৎসাল্যের পদে তিনি শ্রেষ্ঠ। প্রধানতঃ বাংলা ভাষায় পদ রচনায়
তিনি বিখ্যাত।
ব্রজবুলি পদে খ্যাতি অর্জন করেছেন
একজন পরবর্তীকালের বলরাম দাস (কবিরাজ)। ইনি গোবিন্দদাস কবিরাজের ভাগিনেয় বলে
প্রসিদ্ধ। মতান্তরে গোবিন্দদাসের পৌত্র ঘনশ্যামই বলরাম।
২৬. বল্লভদাস
বল্লভদাস নামে দুজন পদকর্তার পরিচয়
পাওয়া যায়। একজন হলেন নরোত্তম দাসের শিষ্য বল্লভ। ইনিই পদাবলি-প্রসিদ্ধ
বল্লভদাস।
এ ছাড়া ‘বংশীলীলা’ গ্রন্থের রচয়িতা বল্লভদাস ছিলেন বংশীবদনের পৌত্র এবং
শচীনন্দনের পুত্র। পূর্বোক্ত বল্লভদাসের সঙ্গে এর কিছু রচনা মিশে যাওয়া সম্ভব।
২৭. বসন্ত রায় ও রায় বসন্ত
বসন্ত রায় ছিলেন নরোত্তম-শিষ্যদের
মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য বৈষ্ণব পদকার। গোবিন্দদাসের পদে এঁর উল্লেখ থাকায় মনে হয়
পরস্পর বন্ধু ছিলেন। গোবিন্দদাসের উল্লেখ থেকে প্রমাণিত হয় তিনি ব্রাহ্মণ ছিলেন।
শেষ জীবনে তিনি বৃন্দাবনবাসী হন বলে প্রসিদ্ধি। এই বসন্ত রায় যশোরের
প্রতাপাদিত্যের খুল্লতাত কি না সে সম্পর্কে সন্দেহ আছে।
২৮. বংশীবদন ও বংশীদাস
নবদ্বীপে গৌরাঙ্গের বয়ঃকনিষ্ঠ
প্রতিবেশী ছিলেন বংশীবদন। পিতার নাম ছ কড়ি ও মাতার নাম চন্দ্রকলা। চৈতন্যের
নীলাচলে গমনের পর শচীমাতা ও বিষ্ণুপ্রিয়ার দেখাশোনা করতেন বংশীবদন। তিনি পদাবলী
রচনায় বংশীবদন ও বংশীদাস দুরকম ভণিতা ব্যবহার করতেন। ষোড়শ শতকে সম্ভবতঃ আর একজন বংশীদাস ছিলেন যিনি একখানি রাগরাগিণী চিহ্নিত
গীতিপ্রধান কৃষ্ণায়ন কাব্য রচনা করেন। সপ্তদশ শতকে শ্রীনিবাস আচার্যের এক শিষ্যের
নাম ছিল বংশীদাস ; তিনিও পদকর্তা
ছিলেন।
২৯. বাসুদেব ঘোষ
বল্লভ ঘোষের পুত্র বাসুদেব অপর দুই
ভ্রাতা মাধব ও গোবিন্দ অপেক্ষা পদ রচনায় শ্রেষ্ঠ ছিলেন। চৈতন্যাশ্রিত কবি বাসুদেব
নিমাই সন্ন্যাস পালাগান রচনা করে অত্যন্ত খ্যাতিলাভ করেছিলেন।
৩০. বিদ্যাপতি
বিদ্যাপতি ছিলেন মিথিলার রাজসভার
কবি। বিহারের দ্বারভাঙ্গা জেলার বিসফী গ্রামে আনুমানিক ১৩৮০ খ্রিস্টাব্দে কবির জন্ম।
পিতা গণপতি। কবি মিথিলার ওইনিবার রাজবংশের সাতজন রাজার পৃষ্ঠপোষকতা
লাভ করে ১৪৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন বলে জানা যায়। শিবসিংহ রূপনারায়ণের
সভাকবি রূপে তিনি অনেকগুলি রাজনামাঙ্কিত পদ রচনা করেন। রাধাকৃষ্ণ পদ ছাড়া
শিববিষয়ক পদ এবং কীর্তিলতা, ভূপরিক্রমা, পুরুষ-পরীক্ষা, শৈবসর্বস্বহার, গঙ্গাবাক্যাবলী, বিভাগসার, দানবাক্যাবলী, লিখনাবলী, দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী
প্রভৃতি বহু গ্রন্থের রচয়িতা রূপে বিদ্যাপতি স্বদেশে বিখ্যাত। শেষজীবনে তিনি
অলঙ্কারশাস্ত্রের অধ্যাপক ছিলেন বলে জানা যায়। বিদ্যাপতির উপাধি ছিল ‘অভিনবজয়দেব’।
--------------------------------------------------------
ঋণ : দেবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
------------------------------------------------------------------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন